আত্মত্যাগের মহিমায় পরিশুদ্ধ হওয়ার উৎসব-ঈদুল আযহা
পোস্ট হয়েছে: জুলাই ২৯, ২০২০

মো. আশিফুর রহমান: প্রতি বছর বিশ্বের মুসলিম জনসাধারণ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ধর্মীয় ভাবগাম্বীর্যের সাথে দুটি বড় উৎসব পালন করে থাকেন। এর একটি ঈদুল ফিত্র- যা পবিত্র রমযান মাস শেষে ১লা শাওয়াল উদ্যাপন করা হয়। আর অন্যটি ঈদুল আযহা- যা উদ্যাপন করা হয় ১০ থেকে ১২ যিলহজ। ঈদুল আযহা আমাদের কাছে কোরবানির ঈদ বলেও পরিচিত।
কোরবানি ইসলাম ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কোরবানি একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো ত্যাগ, উৎসর্গ, নিকটবর্তী হওয়া ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের আশায় নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনে নির্দিষ্ট কিছু হালাল পশু জবাই করাকে কোরবানি বলা হয়।
প্রথম কোরবানি
হযরত আদম (আ.) এর সময় থেকেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করার প্রচলন চলে এসেছে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন মজীদে বলেন, (হে রাসূল!)তুমি তাদের নিকট আদমের দুই পুত্রের সত্য বড় ঘটনা বর্ণনা কর, যখন তারা উভয়ে (আল্লাহর) নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে কোরবানি করল এবং তাদের একজন থেকে কোরবানি গৃহীত হয়েছিল, আর অপরজন থেকে গৃহীত হয়নি; সে (দ্বিতীয়জন) বলল : আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব’, সে (প্রথমজন) বলল : ‘(আমি তো কোনো অপরাধ করিনি)আল্লাহ তো কেবল আত্মসংযমীদের থেকে গ্রহণ করে থাকেন।– সূরা মায়েদা : ২৭
আদম (আ.)-এর এক সন্তান হাবিল অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের আশায় একটি দুম্বা কোরবানি করেছিলেন এবং এটিই আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। পক্ষান্তরে অন্য সন্তান কাবিল অমনোযোগী ও উদাসীনভাবে কিছু খাদ্য শস্য কোরবানি হিসেবে পেশ করেছিল। ফলে তা কবুল হয় নি।
প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি
মানব জাতির শুরু থেকেই প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতে কোরবানি একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচিত ছিল। আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলছেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কোরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’- সূরা হাজ : ৩৪
ইবরাহীম (আ.)-এর কোরবানি
বর্তমানে মুসলিম সমাজে কোরবানির যে প্রচলন তা মূলত মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আত্মত্যাগের স্মরণ। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম (আ.) ও তাঁর ছেলে হযরত ইসমাইল (আ.) কোরবানির নিমিত্তে অনন্য ত্যাগের আদর্শ স্থাপন করে গেছেন মানব ইতিহাসে। হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহ তাআলার নির্দেশে শিশুপুত্র ইসমাইলকে কোরবানি দিতে চেয়েছিলেন। মহান আল্লাহ হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পরম আনুগত্য ও সঙ্কল্পের দৃঢ়তা দেখে তার কোরবানি কবুল করে নেন এবং হযরত ইসমাইল (আ.)-এর স্থলে একটি দুম্বা কোরবানি মঞ্জুর করেন।
এ বিষয়টি পবিত্র কোরআনে এভাবে এসেছে- সুতরাং আমি তাকে এক ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম। অতঃপর সে যখন তার পিতার সাথে শ্রম দেওয়ার উপযুক্ত হলো তখন সে (ইবরাহীম) বলল : হে বতস! নিশ্চয়ই আমি স্বপ্ন দেখছি যে, তোমাকে আমি যবেহ করছি, এখন তুমি দেখ, তোমার অভিমত কী? সে বলল : হে পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তার ওপর কর্মরত হোন; আল্লাহ ইচ্ছা করলে অচিরেই আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ অতঃপর যখন উভয়ে (আদেশ) শিরোধার্য করল এবং সে (পিতা) তাকে (পুত্রকে) কপালের ওপর উপুড় করে শায়িত করল তখন আমরা তাকে আহ্বান করে বললাম : হে ইবরাহীম! নিঃসন্দেহে তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ; এরূপে আমরা পুণ্যকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা (তোমার জন্য) প্রকাশ্য পরীক্ষা ছিল; এবং আমি এর পরিবর্তনস্বরূপ এক মহাকোরবানিকে সাব্যস্ত করেছি, এবং তার স্মরণকে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বিদ্যমান রেখেছি। ইবরাহীমের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। এরূপেই আমরা পুণ্যকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি।– সূরা সাফফাত : ১০১-১১০
কোরবানির গুরুত্ব ও ফযিলত
মুসলমানরা প্রতি বছর পশু কোরবানি করার মাধ্যমে প্রতীকিভাবে নিজেদের মধ্যকার পাশবিকতাকে ত্যাগ করার খুশিকে উদ্যাপন করেন। তারা কৃপ্রবৃত্তিকে বিসর্জন করার মহড়া দিয়ে থাকেন। আল্লাহর রাস্তায় সকল কিছুকে বিলিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুতি ঘোষণা করেন।
কোরবানি মানুষের ঈমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি করে ও পরকালের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে। একারণেই মহান আল্লাহ বলেন যে, তাঁর কাছে কেবল তাকওয়া পৌঁছে। (সূরা হজ : ৩২)
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে মহানবী (সা.)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘অতএব, আপনি আপনার পালনকর্তার উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন’ (সূরা কাউসার, আয়াত ২)।
মহানবী (সা.) মদিনার জীবনে সবসময় কোরবানি করেছেন এবং কোরবানি করার জন্য তাঁর সাহাবিদেরকে নানাভাবে উতসাহিত করেছেন। তিনি কোরবানিদাতার জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সীমাহীন সওয়াব দানের কথা ব্যক্ত করেছেন।
হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, কতিপয় সাহাবা রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) কোরবানি কী? রাসূল (সা.) বললেন, কোরবানি মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইব্রাহীম (আ.) এর সুন্নত। তারা আবারও প্রশ্ন করলেন, এর মধ্যে আমাদের জন্যে কী আছে? রাসূল (সা.) বললেন, কোরবানির পশুর প্রতিটা পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী আছে। তারা বললেন, ভেড়ারতো অসংখ্য পশম আছে। রাসূল (সা.) বললেন, ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী দেয়া হবে, যদি তা খালেস নিয়তে কোরবানি করা হয়।` (ইবনে মাযাহ)
কোরবানিদাতা কোরবানির পশু জবাই করার সময় কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করে থাকেন- ‘ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন’। অর্থাত, ‘আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহতায়ালার জন্য নিবেদিত’। (সূরা আনআম: ১৬২)
এ থেকে বোঝা যায়, কেবল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি দিলে এবং নিজ সত্তার মধ্যকার কলুষতা, আমিত্ব ও অহংকারকে বিসর্জন দিতে পারলেই তা মহান আল্লাহর দরবারে কবুল হবে। এরূপ কোরবানি সম্পর্কেই মহানবী (সা.) বলেছেন, কোরবানির পশুর রক্ত জবাই করার সময় মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়।- মেশকাত
কোরবানির শিক্ষাঃ মহান আল্লাহর নিরঙ্কুশ আনুগত্য ও তাঁর কারণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করাই কোরবানির শিক্ষা। ত্যাগের অনুপম বার্তা নিয়েই প্রতি বছর ঈদ আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়। মুমিন বান্দা পশু কোরবানি দিয়ে আল্লাহ তাআলাকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণের স্পৃহা জাগ্রহ হয়।
হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাইল (আ.)-এর ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ইবরাহীম (আ.)-এর কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন হযরত ইসমাইল (আ.)। আর তাঁকেই কোরবানি করার জন্য আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ.)-কে স্বপ্নে দেখিয়েছিলেন। তাই আমাদেরও উচিত নিজেদের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করা। যেহেতু সকল মানুষ একই মানসিকতার অধিকারী নয় সেহেতু তাদের সকলের কাছে যে একই বস্তু প্রিয় হবে এমনটি কখনই নয়। বরং একেক জনের কাছে একেক জিনিস প্রিয় হতে পারে। কেউ হয়তো নিজেকে ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে চিন্তিত নয়, কারো কাছে হয়তো তার পরিবার-পরিজন সবচেয়ে প্রিয়, আবার কারো কাছে হয়তো তার ধন-সম্পদ, সামাজিক অবস্থান, খ্যাতি ইত্যাদি সবচেয়ে প্রিয় হতে পারে। যেটিই মানুষের কাছে প্রিয় হবে সেটিকেই কোরবানি দেয়ার মানসিকতা তার থাকতে হবে।
এক্ষেত্রে হজ পালনকালে কোরবানি করা প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ড. আলী শরীয়তির একটি বক্তব্যের প্রতি আলোকপাত করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘ইবরাহীমের মতো আপনার ইসমাইলকেও আপনার বুঝে চিনে নিতে হবে। অতঃপর তাকে নিয়ে আসতে হবে মিনায়। কোন্টি আপনার ইসমাইল? আপনাকেই চিনতে হবে, অন্যদের তা চেনার প্রয়োজন নেই। হয়তো আপনার স্ত্রী (স্বামী), চাকুরি, মেধা, যৌনতা, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি, পদমর্যাদা ইত্যাদি এক বা একাধিক যে কোনোটি। আমি জানি না, এর মধ্যে কোন্টি আপনার ইসমাইল, কিন্তু যেটিকে আপনার ইসমাইলসম প্রিয় ও অচ্ছেদ্য বলে মনে হবে, যেমন ইবরাহীমের মনে হয়েছিল, সেইটিই হয়তো আপনার ইসমাইল। যা আপনার দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে বাধা দেয়, আপনার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, যা আপনাকে আমোদিত বিহ্বল করে রাখে, সত্যকে চিনতে ও জানতে বাধা দেয়, বাধা দেয় সত্যের আহ্বান আপনার কাছে পৌঁছাতে, যা আপনাকে দায়িত্ব গ্রহণ না করে নানা অজুহাত-ছলছুতা দাঁড় করাতে প্ররোচিত করে এবং (ঐ ব্যক্তি যে) ভবিষ্যতে আপনার কাছে কিছু পাবে বলে এখন আপনাকে সাহায্য করে-এসবের সবগুলো বা যে কোনো একটিই আপনার ইসমাইল। আপনাকে নিজের জীবনের এই ইসমাইলকে খুঁজে বের করতে হবে, চিহ্নিত করতে হবে। যদি আপনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য পেতে আশা করে থাকেন তাহলে ইসমাইলকে এই মিনায় কোরবানি করে যেতে হবে।’- হজ্জ আমাদের কি শেখায়, পৃ. ৯৭
কোরবানি কবুল হওয়ার শর্ত : কোরবানি কবুল হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। আমাদের উচিত সে বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা ও সচেতন হওয়া। প্রথম শর্তই হচেচ্ছ, কোরবানি কেবলই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে হতে হবে। যদি রিয়া বা লোকদেখানোর উদ্দেশ্য এর মধ্যে থাকে তবে কখনই এমন কোরবানি কবুল হবে না। কেননা, লোকদেখানো ইবাদত শিরকে পর্যবসিত হয়। অনেক সময় মানুষ বেশি দামে বড় পশু কোরবানি করার মাধ্যমে সমাজে সুনাম অর্জন করতে চায়। অথবা অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে অধিক সংখ্যক কোরবানি করে থাকে। এরূপ কর্ম ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণরূপে অবৈধ।
দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, কোরবানি হতে হবে হালাল উপার্জন থেকে। যদি হারাম উপার্জন থেকে কোরবানি দেয়া হয় তবে এটি গ্রহণযোগ্য হবে না।
আরেকটি বিষয় হলো, আল্লাহপাকের দরবারে আমাদের কোরবানি তখনই কবুল হবে, যখন আমরা পশু কোরবানির সাথে সাথে মনের পশুকেও কোরবানি করতে পারব। অর্থাত যাবতীয় পাপ ও হারাম কাজ থেকে বিরত থাকতে পারব এবং হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণা, পরশ্রীকাতরতা, অহমিকা, স্বার্থপরতা, ভোগবাদী প্রবণতা ইত্যাদি কুপ্রবৃত্তিকে কোরবানি দিতে পারব। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন-
“মনের মাঝে পশু যে তোর
আজকে তারে কর জবেহ,
পুল সেরাতের পুল হতে পার
নিয়ে রাখ আগাম রশিদ।”- ঈদজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ
যদি এ বিষয়গুলো হতে আমরা মুক্ত হতে না পারি তবে পশু কোরবানি আমাদের জন্য কোনো উপকার বয়ে আনবে না। আর এজন্যই দেখা যায়, কোরবানিদাতা একদিকে যেমন ইসলামের অবশ্যকরণীয় বিষয়গুলো থেকে দূরে থাকছেন, অন্যদিকে অবৈধ কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। এতে বোঝা যায়, কোরবানিদাতা কোরবানির প্রকৃত শিক্ষাকে ধারণ করতে পারে নি। অথচ কোরবানির মাধ্যমে কে কতটুকু আত্মত্যাগ করছে, নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে এবং ধর্মীয় নির্দেশ মান্য করছে, মহান আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন। আর আল্লাহর কাছে কেবল মানুষের তাকওয়া পৌঁছায়, কোরবানিকৃত পশুর রক্ত, মাংস কিছুই পৌঁছে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর নিকট কখনই না সেগুলোর মাংস পৌঁছায়, আর না সেগুলোর রক্ত, তবে তাঁর নিকট তোমাদের তাকওয়া (আত্মসংযম) পৌঁছায়।’- সূরা হজ: ৩২
কোরবানির মাংসের বণ্টন
কোরবানির পশুর মাংসগুলো তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের জন্য রেখে এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বণ্টন এবং অন্য ভাগ গরিবদের জন্য দান করতে হয়। এভাবে কোরবানির আনন্দকে সকলের সাথে ভাগ করে নেয়া হয়। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলে আনন্দে শরীক হতে পারে। এ আনন্দ ভাগাভাগি করার মাধ্যমে পরস্পরের সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়, সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হয়, মানবিকতার দিকটি স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
উপসংহার
কোরবানির উদ্দেশ্য হল আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু মনে করে প্রতীকী অর্থে পশু কোরবানি করা। এ ধর্মীয় উতসবে তাই ত্যাগের মহিমা বিজড়িত। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বকরীদ’ কবিতায় ইবরাহীম (আ.)-এর প্রসঙ্গ টেনে বলেন-
ইব্রাহিমের কাহিনি শুনেছ? ইসমাইলের ত্যাগ?
আল্লারে পাবে মনে কর কোরবানি দিয়ে গরু ছাগ?
আল্লার নামে, ধর্মের নামে, মানব জাতির লাগি
পুত্রেরে কোরবানি দিতে পারে, আছে কেউ হেন ত্যাগী?
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা কোরবানির মাধ্যমে আমরা পেতে পারি। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কস্মিণকালেও কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যদি তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে তোমরা ব্যয় না কর। আর তোমরা যদি কিছু ব্যয় করবে আল্লাহ তা জানেন।’- সূরা আলে ইমরান: ৯২
মহান আল্লাহর পথে শুধু প্রিয় বস্তু নয়; বরং সর্বস্ব কোরবানি করার উতকৃষ্ট নমুনা হলেন বেহেশতের যুবকদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)। যখন আমীরে মুয়াবিয়া তাঁর অযোগ্য পুত্র ইয়াযীদকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা মনোনীত করেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর ইয়াযীদ খলিফার পদে আসীন হয় তখন সে একের পর এক ইসলামের বিধান লঙ্ঘন করা শুরু করে। হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল ঘোষণা দিতে থাকে। সে ইসলামকে ধ্বংসের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় ইসলামকে টিকিয়ে রাখতে ইমাম হোসাইন (আ.) নিজের পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গীদেরকে সাথে নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানির সুমহান ও অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এটিই প্রকৃত কোরবানি। যখনই প্রয়োজন হবে তখনই আল্লাহর রাস্তায় সকল কিছু উতসর্গ করার মনোবৃত্তি না থাকলে কোরবানি নিছকই আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হবে, এ থেকে আমরা কোনো কল্যাণই লাভ করতে সক্ষম হব না।
বস্তুত ভোগের মধ্যে নয়; বরং ত্যাগের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সুখ। নিছক ধর্মীয় অনুশাসন পালন বা লোকদেখানো আয়োজন বা প্রতিযোগিতার মনোবৃত্তি যেন আমাদেরকে কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে না নেয় সেটিই হোক আমাদের একান্ত কাম্য।