শুক্রবার, ৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

অমর শহীদানের স্মৃতিতে ভাস্বর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান

পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৬ 

নূর হোসেন মজিদী
হাজার হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে ইরানের জনগণ আড়াই হাজার বছরের পুরাতন স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমন, বহিঃশক্তির তাঁবেদার শাহের তাগূতী সরকারকে উৎখাত করে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবকে বিজয়ী করে এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে বিজাতীয় শক্তির অনুগত ইরান আক্ষরিক অর্থে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং শত্রুর চাপিয়ে দেয়া আট বছরব্যাপী যুদ্ধ ও দশকের পর দশক ধরে অব্যাহত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে মোকাবিলা করে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ হিসেবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।
বস্তুত ইসলামী বিপ্লবের বিজয় ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আধিপত্যবাদী বৃহৎ শক্তিবর্গের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে স্বাধীনভাবে পথ চলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বের মযলুম জাতিসমূহের সামনে একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। ইসলামী ইরান তার এ গৌরবময় অবস্থান ও মর্যাদার জন্য স্বীয় শহীদানের কাছে ঋণীÑ যাঁরা ইসলামী বিপ্লবকে বিজয়ী করার আন্দোলনে এবং এরপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে ও প্রতিবিপ্লবী অন্তর্ঘাতকদের হাতে জীবন বিসর্জন দিয়ে ইসলামী বিপ্লবরূপ চারাগাছের গোড়ায় প্রাণরস সঞ্চারিত করেছেনÑ যার ফলে আজ তা এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হতে পেরেছে। তাই ইসলামী ইরানের জনগণ ও সরকার স্বীয় শহীদানকে বিভিন্নভাবে মর্যাদা প্রদান করেছে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে বিজয়ী করার আন্দোলনে সর্বস্তরের হাজার হাজার দ্বীনদার মানুষ শহীদ হয়েছেন এবং দীর্ঘ আট বছরব্যাপী চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন আরো কয়েক লক্ষ মানুষ। এছাড়া প্রতিবিপ্লবীদের সন্ত্রাসী তৎপরতার শিকার হয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন। এ শহীদগণের মধ্যে রয়েছেন দেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেণ্ট ও প্রধানমন্ত্রীসহ সর্বস্তরের মানুষ। ইরানী জাতির শহীদগণের মধ্যে সাধারণ মানুষ, দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও সাধারণ সৈনিকগণ ছাড়াও রয়েছেন বিপুল সংখ্যক আলেম, শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিচারক, পার্লামেন্টারিয়ান ও সেনানায়ক।
ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পূর্বে ও পরে যেসব খ্যাতনামা ব্যক্তি শাহাদাত বরণ করেন তাঁদের সকলের নামের তালিকা তৈরি করতে গেলে তা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন স্বনামখ্যাত মনীষী ও মুজতাহিদ শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ্ মোতাহ্হারী, স্বনামখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ অধ্যাপক ড. আলী শারী‘আতী, প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ আলী রাজাই, প্রধান মন্ত্রী হুজ্জাতুল ইসলাম ড. জাওয়াদ বহোনার, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আয়াতুল্লাহ্ মোহাম্মাদ হোসেইন বেহেশতী, আয়াতুল্লাহ্ মোস্তাফা খোমেইনী, আয়াতুল্লাহ্ সাদূক্বী, ড. মোহাম্মাদ মোফাত্তেহ্, ড. মোস্তফা চামরান প্রমুখ। সাম্প্রতিককালে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বেশ কয়েক জন পরমাণুবিজ্ঞানী সাম্রাজ্যবাদী ও যায়নবাদী ইসরাঈলের নিয়োজিত গুপ্ত ঘাতকদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন।
এখানে বিপ্লব-পূর্ববর্তী ও বিপ্লবোত্তর ইরানের গুরুত্বপূর্ণ শহীদ ব্যক্তিত্ববর্গের মধ্য থেকে কয়েক জন সম্পর্কে সামান্য আভাস দেয়া যেতে পারে।
অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ্ মোতাহ্হারী ছিলেন সাম্প্রতিক ইরানের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী চিন্তাবিদগণের অন্যতমÑ যিনি ইসলামের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় অনেক বই-পুস্তক লিখেছেন। তাঁর লেখার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি ইসলামের জটিলতম বিষয়গুলোকেও সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের বোধগম্য প্রাঞ্জল ভাষায় সাফল্যের সাথে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর বক্তৃতা ও লেখা বিশ্ববিদ্যালয় ও দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্রের ছাত্রছাত্রীদের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয় ছিল। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরকে ইসলামের পথে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল খুবই বেশি। ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের কিছুদিন পরে সাম্রাজ্যবাদের দোসর প্রতিবিপ্লবী সন্ত্রাসীদের গুলিতে তিনি শহীদ হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে ইসলামী ও বৈপ্লবিক চেতনা সৃষ্টিতে বিশেষ অবদান রাখেন এমন আরেক জন ব্যক্তিত্ব ছিলেন অধ্যাপক ড. আলী শারী‘আতী। ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের কিছুদিন আগে তিনি লন্ডনে শাহী সরকারের গুপ্ত ঘাতকের হাতে শাহাদাত বরণ করেন।
বিদেশ বিভূঁইয়ে শাহী সরকারের গুপ্ত ঘাতকের হাতে শাহাদাত বরণ করেন এমন আরেক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র আয়াতুল্লাহ্ মোস্তাফা খোমেইনী। তিনি বিপ্লব বিজয়ের কিছুদিন আগে ইরাকের নাজাফেÑযেখানে তিনি তাঁর নির্বাসিত পিতার সাথে অবস্থান করছিলেনÑগুপ্ত ঘাতকের হাতে শাহাদাত বরণ করেন।
ইসলামী বিপ্লবের বিজয় ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান প্রতিষ্ঠিত হবার পর জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট ছিলেন মোহাম্মাদ আলী রাজাই এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের তৎকালীন সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন স্বনামখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ হুজ্জাতুল ইসলাম ড. জাওয়াদ বহোনার। উভয় নেতা এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে থাকা অবস্থায় প্রতিবিপ্লবী সন্ত্রাসীদের পেতে রাখা এক বোমা বিস্ফোরণের ফলে শহাদাত বরণ করেন।
আয়াতুল্লাহ্ ড. মোহাম্মাদ হোসেইন বেহেশতী ছিলেন ইসলামী বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী আরেক জন মহান ব্যক্তিত্ব। বিশেষ করে বিপ্লবোত্তর ইরানে প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি যে দৃঢ় ভূমিকা পালন করেন তা বিপ্লবের হেফাযতের ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখেছিল। তৎকালীন ইসলামী সরকারের কয়েক জন মন্ত্রী ও মজলিসে শূরায়ে ইসলামী (পার্লামেন্ট)-এর সদস্য এবং বেশ কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে থাকাকালে প্রতিবিপ্লবী সন্ত্রাসীদের পেতে রাখা একটি শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণের ফলে সংশ্লিষ্ট ভবনটি পুরোপুরি ধসে পড়ে। এর ফলে ড. বেহেশতী বাহাত্তর জন সাথিসহ শাহাদাত বরণ করেন।
ইসলামী ইরানের শহীদগণ তাঁদের পবিত্র রক্তের দ্বারা ইসলামী বিপ্লবকে বিজয়ী ও সুরক্ষিত করেছেন এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান রূপ চারাগাছটিতে প্রাণরস সঞ্চারিত করে বিশাল মহীরুহে পরিণত করেছেন। তাঁরা তাঁদের অবদান, ইসলামী বিপ্লব ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের মধ্যে বেঁচে আছেন এবং প্রতি মুহূর্তে সকলকে তাঁদের অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। তবে ইরানী জনগণ ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার স্বীয় শহীদানের স্মরণকে কেবল এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে নি, বরং তাঁদের নাম সরকারি ও বেসরকারি নির্বিশেষে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার সাথে জুড়ে দিয়ে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে শহীদগণের নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানÑ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্র, মসজিদ, গ্রন্থাগার, গবেষণাগার, বিজ্ঞান সংস্থা, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন, হাসপাতাল এবং বহু সরকারি স্থাপনা। এছাড়া তাঁদের নামে নামকরণ করা হয়েছে অসংখ্য বাজার, ময়দান, মহাসড়ক, সড়ক, গলি ও সেতুর। আর এ নামকরণ কেবল রাজধানী তেহরানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমগ্র ইরানের অসংখ্য শহর, উপশহর ও গ্রামে এভাবে তাঁদের নামে অনেক কিছুর নামকরণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে শীর্ষস্থানীয় শহীদ ব্যক্তিত্ববর্গের নামে যেমন বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামকরণ করা হয়েছে তেমনি অন্য শহীদগণের নামে স্থানীয়ভাবে অনেক কিছুর নামকরণ করা হয়েছে। এভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বত্র শহীদগণের স্মৃতিকে জীবিত রাখার যত নিদর্শন রয়েছে সে সবের ফিরিস্তি তৈরি করা আক্ষরিক অর্থে অসম্ভব না হলেও খুবই কঠিনÑ প্রায় অসম্ভব; তা করতে গেলে বিশাল এক বিশ্বকোষ রচনা করতে হবে। এখানে উদাহরণ স্বরূপ তেহরানের মাদ্রাসায়ে আলীয়ায়ে শহীদ মোতাহ্হারী, অধ্যাপক মোতাহ্হারী ‘ইল্মী ও সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন, শহীদ বেহেশতী বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়), শহীদ বেহেশতী চিকিৎসাবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়, তেহরানের চামরান হাসপাতাল, আহ্ওয়াযের শহীদ চামরান বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
এভাবে কেবল শহীদগণের স্মৃতিকে অমর করে রাখার মাধ্যমেই তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে যথেষ্ট গণ্য করা হয় নি, বরং শহীদগণের পরিবারবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে তাঁদের যে কোনো ধরনের প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে বোনিয়াদে শহীদ (শহীদ ফাউন্ডেশন) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের অস্তিত্বের সাথে তার শহীদানের অস্তিত্বের সম্পর্ক চিরদিন অবিচ্ছেদ্য হয়ে থাকবে এবং তাঁদের স্মরণ চিরদিন অমর হয়ে থাকবে। সেই সাথে তাঁরা চিরদিন ইরানী জনগণের জন্য উন্নত শির হয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।