অমর কবি ফররুখ আহমদ
পোস্ট হয়েছে: আগস্ট ৬, ২০১৪
মাসুদ মজুমদার
বাংলা কাব্য সাহিত্যের অনন্য দিকপাল কবি ফররুখ আহমদ। নজরুল যুগের পর দিগন্ত উন্মোচন করে এ কবির আবির্ভাব। যুগ বিচারে ফররুখ যুগের সৃষ্টি নয়, স্রষ্টা। কাব্য ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নতুন ভাবধারার সন্ধান এবং সর্বপ্লাবী সাহিত্যচর্চায় কালোত্তীর্ণ ধারা সৃষ্টিতে তিনিই তাঁর উপমা। জীবন সত্য এবং কাব্য সত্যের আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছিল একমাত্র ফররুখ এর জীবনেই। যে আদর্শ এবং চেতনায় তিনি অবগাহন করেছিলেন কাব্য সৃষ্টির দিগন্ত উন্মোচনে সেই চৈতন্যই ছিল তাঁর উপলব্ধির সহজাত প্রেরণা। তাই তিনি রেনেসাঁর চেতনাদীপ্ত কবি। তুলনাহীন মানবতাবাদী।
কাব্যে তিনি সন্ধান করেছেন সৃষ্টি সুন্দরকে। স্রষ্টার মহত্ত্বকে। জাতিসত্তার তর্কাতীত উৎস মূল এবং সতত প্রবহমান মূল স্রোতধারাকে। সঙ্গত কারণেই তাঁর কাব্যে ভর করেছে মানবতার আকুতি, স্বপ্ন এবং কাঙ্ক্ষিত প্রগতি। সাহিত্যের প্রতিযোগী তিনি ছিলেন না। স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, স্বতন্ত্রধারা তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছে তাঁর যোগ্য আসনে। তাঁর কাব্যলক্ষী নদী, ফুল, নারী কিম্বা প্রকৃতির মাঝেই শুধু বিচরণ করেনি। সিন্দাবাদ, নৌফেল হাতেমের হাত ধরে সাত সাগর পাড়ি দিয়েছে। দুর্ভিক্ষের সাথে লড়েছে, লাশের মিছিলে হেঁটেছে, জড় সভ্যতাকে জ্ঞঞ্জালের মতো ঠেলেছে। সামনে এগিয়ে যাবার কোরাসে নব উত্থানের জয়গান গেয়েছে।
ঈগল চোখে সমাজ-সভ্যতা, যুগ, কাল এবং সময় পর্যবেক্ষণ করার এমন আশ্চর্য শক্তি আর কার ছিল। স্থবিরতাকে ভেঙে চুরমার করে জাগরণের গান গেয়ে হেরার রাজতোরণ প্রদর্শনের অঙ্গীকার শুধুই ভর করছিল ফররুখের কাব্যে, ব্যক্তিসত্তায়, কাব্যসত্তায়। স্বপ্ন রাজ্যের দুঃসাহসী নায়ক সিন্দাবাদকে দিয়ে তিনি জাগরণের ঢেউ তুলেছেন। যুগ প্রবর্তক এ কবি অসাধারণ দক্ষতায় আকাশের মুক্তবিহঙ্গ শাহীনকে উড়িয়েছেন- সেই সাথে মর্যাদাবোধের প্রতীক হয়ে অনমনীয় ফররুখ আপোষহীন থেকে এক বিস্ময়কর কবি আসনকে তর্কাতীতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। আধুনিক কবিতার ব্যতিক্রমী এ শিল্পী ন্যায়ের পথে তাৎক্ষণিক হয়তো এক নিঃসঙ্গ কবি। কিন্তু যাঁরা তাঁকে নিয়ে হেঁয়ালি প্রদর্শন করেছেন তাঁরা কেউ বিষয়, ছন্দ, সমীক্ষা, কবিতার শরীর নির্মাণ এবং অভিনবত্বে তাঁকে অতিক্রম করতে পারেননি। তাই তাঁর শত্রুদের পক্ষেও তাঁকে অস্বীকার করা অসম্ভব। অনেকের ধারণা কবি ফররুখ তাঁর স্বপ্নরাজ্যে নিঃসঙ্গ এবং একা। তাদের ধারণা কতটা স্ববিরোধী এবং রাজনৈতিক ভেদবুদ্ধিতাড়িত, বাংলা সাহিত্যের আজকের সমৃদ্ধ অবয়ব দেখেই তা অনুভব করা সম্ভব।
তাঁর ডাহুক এখনও ডাকছে। তাঁর সমুদ্র-নাবিক এখনও পাল তুলছে। তাঁর হাতেম এখনও মানবতার জয়গান গায়। কিন্তু নিন্দুকেরা সাহিত্যের আসরে ঠাঁই পায়নি, কাব্যের জগতে টিকেনি, স্থায়ী আসন সৃষ্টিতো দূরের কথা, সমকালীন আসন থেকেও ছিটকে পড়েছে। ঐতিহ্যের রূপকার ফররুখ এখনো নারঙ্গীবনের সবুজ পাতায় কাঁপন তুলছেন।
ফররুখ মানস মানে কাব্য সচেতন, স্ববিরোধহীন, সচেতন এক কাব্যসম্রাট, কাব্যনাট্যের দিকপাল, অমূল্য সনেটের স্রষ্টা, আধুনিক কাব্য-সাহিত্যের বিস্ময়কর প্রতিভা।
যে সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যা লালন করেছেন, সাহিত্যের স্মৃতিতে তা অশেষ। তাঁর কবি কৃতি, জীবন বোধ, জাতীয় চেতনা আমাদের চেতনার উচ্চারণে এতটা ভাস্বর যে, ফররুখের আকাঙ্ক্ষা মানে আজকের জাতিসত্তার আকাঙ্ক্ষা, তাঁর অকৃত্রিম বিশ্বাস আজকের নব জাগৃতির সিপাহসালারদের বিশ্বাস। তাঁর স্বপ্ন একজন প্রগতিশীল সমাজকর্মীর স্বপ্ন। জীবনবোধের উজ্জীবিত লড়াকু বিপ্লবীর স্বপ্ন। বাংলা কাব্যে ফররুখের অবস্থান হুইটম্যান, গ্যাটে, মিল্টন, এলিয়ট, কীটস, শেলীর সাথে তুল্য মনে করা হয়। শব্দ, উপমা, ইমেজ এবং রূপকল্প সৃষ্টিতে কুশলতায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। নজরুল আরবি-ফারসি শব্দ তুলে এনেছেন কাব্যের শরীরে, ফররুখ সে ধারাকে করেছেন ঐশ্বর্যমণ্ডিত।
ছন্দে তিনি যাদুকর ছিলেন না, ছিলেন বিপ্লবী। মধু কবি, রবিঠাকুর, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধ দেব এর কাব্যের সাথে মিলিয়ে দেখলে এ সত্য আবিষ্কার করা যাবে না।
প্রভাবমুক্ত স্বতন্ত্র পথ রচনায় অন্যদের কৃতিত্ব যেখানে গৌণ, ফররুখ সেখানে সমুজ্জুল। বিষয় ও ছন্দ-সমীক্ষায় বিশেষত কাব্যনাট্যের জগতে ফররুখের উপস্থিতি সমসাময়িক সকল কবিকেই ঈর্ষাকাতর করেছে। সুনির্দিষ্ট মাত্রা, যতি, পর্ব, প্রয়োগে নিয়মরীতির অধীনে ছন্দবদ্ধ কবিতা ও গদ্য ছন্দের কবিতা রচনায়ও ফররুখের সাফল্য প্রচুর।
ফররুখ কাব্যে আঙ্গিক-বৈচিত্র্য, ভাব-ভাষা নিয়ে যে অবলম্বন তাতে কবি আধুনিকতার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
কালজয়ী ঐতিহ্য সচেতন আধুনিক মানসের যুগ প্রবর্তক এ কবির জন্ম উনিশ শ’ আঠারো সালের দশ জুন। যশোহর জেলার মাঝ আইলে তাঁর পৈত্রিক নিবাস। বাবা খান সাহেব সৈয়দ হাতেম আলী, মা বেগম রওশন আখতার। কবির পুরো নাম সৈয়দ ফররুখ আহমদ। মা-বাবার দ্বিতীয় পুত্র ফররুখ নিজের নামের সাথে সাধারণত ‘সৈয়দ’ শব্দটি ব্যবহার করতেন না। শৈশবে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে, কৈশোরে কলকাতার তালতলা মডেল স্কুলে, বালিগঞ্জ হাইস্কুল ও পরে খুলনা জেলা স্কুলে লেখাপড়া করেন। খুলনা জেলা স্কুল থেকেই তিনি প্রবেশিকা পাস করেন। উনিশ শ’ উনচল্লিশ সালে রিপন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ ও সিটি কলেজেও তিনি পড়াশোনা করেছেন। আইএ পাস করার পর প্রথমে তিনি দর্শন এবং পরে ইংরেজিতে অনার্স পড়ার জন্য বিএ-তে ভর্তি হন। কিন্তু তাঁর অনার্স পরীক্ষা দেয়া হয়নি। অনেকেই মনে করেন, সম্ভবত কাব্যচর্চায় মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক প্রবণতা তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জগতে টিকে থাকতে দেয়নি।
বিয়াল্লিশ সালে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুনের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তেতাল্লিশ সালে কর্মজীবনে প্রবেশ করে প্রথমে আইজি প্রিজন অফিস এবং সিভিল সাপ্লাইতে চাকুরী করেন। স্বল্প কালের এ চাকরি ছেড়ে পয়ঁতাল্লিশ সালে স্বল্প সময়ের জন্য ‘মাসিক মোহাম্মদী’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে জলপাইগুড়িতে সামান্য কিছুদিন চাকরি করেন। দেশ বিভাগের পর প্রথমে খণ্ডকালীন এবং পরে নিয়মিত শিল্পী হিসাবে রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা কেন্দ্রে কাজ করেন। একাত্তর সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পী হিসাবে উনিশ শ’ চুয়াত্তর সালের উনিশ অক্টোবর মৃত্যু পর্যন্ত এ চাকরিতে বহাল ছিলেন।
বিস্ময়কর এ প্রতিভার প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আসে ষাট সালে ‘প্রেসিডেন্ট পুরস্কার’-এর মাধ্যমে। একই সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। ছেষট্টি সালে ‘হাতেম তায়ী’ গ্রন্থটির জন্য তিনি আদমজী পুরস্কার, একই সালে ‘পাখির বাসা’ গ্রন্থটির জন্য ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেন। জীবদ্দশায় একষট্টি সালে তৎকালীন ঢাকা হলে সর্বস্তরের সংস্কৃতি সেবীদের পক্ষ থেকে সম্বর্ধিত হন।
মৃত্যুর পর এ যুগস্রষ্টা কবিকে সাতাত্তর সালে মরণোত্তর একুশের পদক, আশি সালে স্বাধীনতা পুরস্কার এবং চুরাশি সালে ইসালিমক ফাউন্ডেশন পুরস্কার প্রদান করা হয়।
চুয়াল্লিশ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়ে কবির প্রথম অমর কাব্য ‘সাত সাগরের মাঝি’ পঁচাত্তর সাল নাগাদ তিনবার প্রকাশিত হয়েছে। তারপর একে একে প্রকাশ পায় আজাদ করো পাকিস্তান, সিরাজাম মুনীরা, নৌফেল ও হাতেম, মুহূর্তের কবিতা, হাতেমতায়ী, পাখির বাসা, হরফের ছড়া, নতুন লেখা, ছড়ার আসর (এক), শ্রেষ্ঠ কবিতা, হে বন্য স্বপ্নেরা, নয়া জামাত (চার খণ্ড), ফররুখ রচনাবলী (প্রথম খণ্ড), ইকবালের নির্বাচিত কবিতা, চিড়িয়াখানা, কাফেলা, হাবেদা মরুর কাহিনী, সিন্দাবাদ-নামে চুরাশি সাল নাগাদ বিশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তখন পর্যন্ত ছাপার অপেক্ষায় ছিল দিলরুবা, ফুলের জলসা, সাঁঝ সকালের কিস্সা ও কিস্সা কাহিনী নামক চারটি গ্রন্থ। শিশু-কিশোরদের জন্য প্রকাশের অপেক্ষায় পাণ্ডুলিপির সংখ্যা ছিল সাতটি, ছড়ার আসর (দুই, তিন), অলোকলতা, খুশীর ছড়া, ছড়াছবির দেশে, মজার ছড়া, পাখির ছড়া, রং মশলা। ব্যঙ্গ কবিতা, গান ও অনুবাদের সমাহার নিয়ে আরো দশটি পাণ্ডুলিপির সন্ধান মিলেছে। অনুস্বার বিসর্গ, ঐতিহাসিক অনৈতিহাসিক হাল্কা লেখা, তসবির নামা, রসরঙ্গ, রাজ রাজড়া, কাব্যগীতি, রক্ত গোলাব, মাহফিল, কোরান মঞ্জুষা। পারিবারিক সূত্রে যদ্দুর জানা যায়, সময়ান্তে কবির আরো কিছু পাণ্ডুলিপির সন্ধান মিলে যেতে পারে।
ফররুখের অন্য এক পরিচয় রোমান্টিক হিসাবে। বিশ্বাসের কবি হিসাবে অন্য পরিচয়টি তাঁকে নতুন প্রজন্মের কাছে স্বতন্ত্রধারার পথিকৃৎ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
খ্যাতিমান ও প্রতিষ্ঠিত অন্য কোন কবি শিশু-কিশোরদের জন্য এতবেশি লেখালেখি করেননি। সাহিত্য বিচারে, শিল্পমান, নৈতিক ভিত্তি তাঁর সৃষ্ট শিশু সাহিত্যকে বিশেষত্ব দিয়েছে। অনুসন্ধিৎসু শিশু মনে তাঁর পাখির বাসা, চিড়িয়াখানা প্রভৃতি দোলা দিবে অমর সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য নিয়ে।
ফররুখের কবি মানস এবং ব্যক্তি মানস ছিল বিরোধহীন, অভিন্ন। কবিতার বিভিন্ন বাঁকে কবির উপস্থিতি এতটা বলিষ্ঠ ও বক্তব্য প্রধান হয়েও আধুনিক এ কবির কাব্যচর্চার পরিধি এতটা বিস্তৃত হতে পেরেছে শুধুই বড় মাপের স্বভাবকবি হবার সুবাদে। কবির কবিতা সমালোচনা এবং কাব্য মান বিচার করার সামর্থ্য আমার নেই, কিন্তু ভালো লাগা কবিতা থেকে কিছু উদ্ধৃতির অধিকার নিশ্চয়ই আছে।
হেরার তোরণ মিলাবে সম্মুখে জানি!
তবে নোঙ্গর তোলো,
তবে তুমি পাল খোলো,
তবে তুমি পাল খোলো।
**
সওদাগরের দল মাঝে মোরা ওঠায়েছি আহাজারী,
ঘরে ঘরে উঠে ক্রন্দন ধ্বনি আওয়াজ শুনেছি তারি,
ওকি বাতাসের হাহাকার, ওকি রোনাজারি ক্ষুধিতের।
ওকি দরিয়ার গর্জন, ওকি বেদনা মজলুমের
ওকি ক্ষুধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয় ভেরী!
পাঞ্জেরী!
**
জাগো! বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি,
জাগো! অগনন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি;
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরী, কত দেরী!!
**
কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হ’ল জানি না তা,
নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা,
দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা,
তবু জাগালে না? তবু তুমি জাগালে না?
**
কেটেছে রঙিন মখমল দিন, নতুন সফর আজ,
শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক,
ভাসে জোরওয়ার মউজের শিরে সফেদ তাদির তাজ,
পাহাড়-বুলন্দ ঢেউ বয়ে আনে নোনা দরিয়ার ডাক;
**
হ জড় সভ্যতা
মৃত সভ্যতার দাস স্ফীত মেদ শোষক সমাজ,
মানুষের অভিশাপ নিয়ে যাও আজ।
তার পর আসিলে সময়
বিশ্বময়
তোমার শৃংখলগত মাংসপি-ে পদাঘাত হানি,
নিয়ে যাব জাহান্নাম দ্বার-প্রান্তে টানি,
আজ এই উৎপীড়িত মৃত্যুদীন নিখিলের অভিশাপ বও
ধ্বংস হও
তুমি ধ্বংস হও।
**
জানি না মানুষের লাশ মুখ গুঁজে পড়ে আছে জমিনের পর
সন্ধ্যার জনতা জানি কোন দিন রাখে না সে মৃত্যুর খবর।
**
রাত্রিভর ডাহুকের ডাক…
এখানে ঘুমের পাড়া স্তব্ধ নিবিড় সুপ্তির
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি।
ছলনার পাশাখেলা আজ পড়ে থাক;
ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি,
কান পেতে শোন আজ ডাহুকের ডাক।
***
খঞ্জরে ভাঙো জিঞ্জির ভীতি
কাঁপুক দুনিয়া টালমাটাল।
***
তীব্র ব্যথায় ঢেকে ফেলে মুখ দিনের সূর্য অস্তাচলে,
ডোবে ইসলাম রবি এজিদের আঘাতে অতল তিমির তলে,
কলিজা কাঁপায়ে কারবালা মাঠে ওঠে ক্রন্দন লোহুসফেন
ওঠে আসমান জমিনে মাতম কাঁদে মানবতা হায় হোসেন।
***
আজ সংগ্রাম নিজেকে চেনার,
মানবতা নিয়ে বেচা কেনার
হাটের ভীড়ে,
সময় এসেছে সকল দেনার
সকল হিসাবে মেটাতে ফিরে।
ঋণ শুধবার দিন
আজ সংগ্রাম নিজের সংগে
নিজেকে চেনার দিন।
যতই উদ্ধৃতি দেয়া যাবে শক্তিশালী এ শিল্পীর কাব্যলক্ষীকে ততই ধরা যাবে, ছোঁয়া যাবে, অনুভব করা যাবে। অনুভবের অলিন্দে এমন হৃদয় ছোঁয়া ধ্বনি শুধুই আপ্লুত করে, হৃদয় তন্ত্রিতে সুর তোলে। এ অনুভব গানে, শিশু সাহিত্যে, সনেটে, প্রতিটি কাব্যের পঙ্ক্তিতে।
অনেকেই মনে করেন ফররুখ অভিমান করে চলে গেছেন। নির্দয়, নিষ্ঠুর, পাষাণ সমাজের ওপর ছিল তাঁর সীমাহীন ও নিদারুণ অভিমান। ফররুখের মৃত্যু নিছক মৃত্যু নয়। অবজ্ঞা, অবহেলা, অবমূল্যায়ন তাঁকে জীবনের শেষ দিনগুলোতে অর্ধাহার, অনাহার ও দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল। এক রকম চিকিৎসাহীন অবস্থায় এ অমর কবি পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। এ এক নিষ্ঠুর যন্ত্রণায় আমরা নতুন প্রজন্ম দায়বোধে আবদ্ধ।
ক্ষমতার দাপটে মিথ্যা অহমিকার একদল মানুষ তাঁর বিশ্বাসকে খণ্ডিত করতে চেয়েছিল, সাম্প্রদায়িকতার মিথ্যা অভিযোগে দায়ী করার হীন মানসিকতা ছিল। তাদের সাথে অনন্যসাধারণ এ প্রতিভা সামান্যতমও আপোষ করেননি। বিশ্বাসকে অহংকার ভেবে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করেছেন। ব্যথাতুর হৃদয়ে আজ ভাবতে অবাক লাগে, জাতির এ অহংকার, কবি ফররুখ এর কবরের জন্য সাড়ে তিন হাত জায়গা মিলেনি। জ্ঞানতাপস ড. শহিদুল্লাহর মাজারের পাশে একটুকরো জায়গার আকুতি একশ্রেণির মানুষ মঞ্জুর করেনি। বাধ্য হয়ে কবি বেনজীর আহমদ তাঁর কাব্য সতীর্থের লাশ আগলে বলেছিলেন, ‘আমার ভাইকে আমি আমার ডেরায় নিয়ে যাই।’ শাহজাহানপুরে কবি বেনজীরের আম্রকাননে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন যুগশ্রেষ্ঠ, ঐতিহ্য সচেতন, সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি ফররুখ আহমদ। অপরাজেয় কবি মরেও হলেন অমর।
কবি নিজেই লিখেছিলেন,
তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া,
তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া।
জীবনের শেষ মুহূর্তের লেখায় এবং বিশ্বাসে তিনি ছিলেন এক অভিন্ন। তাঁর আহ্বান ছিল শাশ্বত সত্যের আহ্বান। হে কবি! আমাদের সামনে আজও তোমার স্বপ্নের হেরার রাজ তোরণ, তোমার সামনে চিরন্তন শান্তির আবাস জান্নাত। তুমি বিজয়ী, অপরাজেয়। নাবিকের প্রতি তোমার মিনতি, জড় সভ্যতাকে জাহান্নামের দারপ্রান্তে টেনে নেবার আকুতি, আমাদেরও অঙ্গীকার। তুমি বলেছিলে, ‘জান্নাতে ফিরদৌসের সব মুক্ত দরজা তোমাকে ডাকে।’ সত্যি তোমাকে ডাকছে জান্নাত। তুমি পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত, এবার ঘুমাও। তোমার শান্তির ঘুমে সন্বিত ফিরিয়ে দিক আমাদের মুক্তির কোরাস, তোমার প্রিয় আবেহায়াত।