রোমের বাদশার প্রশ্নের জবাবে হযরত আলী (আ.)
পোস্ট হয়েছে: মে ১৪, ২০১৮
ইবনে মুসাইয়্যেব বর্ণনা করেছেন যে, একদা রোমের সম্রাট দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমরের কাছে একটি প্রশ্নের তালিকা প্রেরণ করেন। হযরত উমর সাহাবিদের সামনে প্রশ্নগুলো উপস্থাপন করলেন, কিন্তু কেউ সেগুলোর উত্তর দিতে পারলেন না। এরপর তিনি হযরত আলী (আ.)-এর সামনে প্রশ্নগুলো উপস্থাপন করেন। হযরত আলী প্রশ্নগুলোর ওপর একবার চোখ বুলালেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর লেখা শুরু করলেন। পরে এটি রোমের সম্রাটের নিকট প্রেরণ করা হয়।
নিম্নে প্রশ্নগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো :
১. মহান স্রষ্টা কোন্ জিনিস সম্পর্কে জানেন না?
২. আল্লাহর কোন্ জিনিসটি নেই?
৩. কোন্ জিনিস মুখসর্বস্ব?
৪. কোন্ জিনিস পা’সর্বস্ব?
৫. কোন্ জিনিস চোখসর্বস্ব?
৬. কোন্ জিনিস ডানাসর্বস্ব?
৭. সেই ব্যক্তি কে যাঁর কোনো পূর্বপুরুষ নেই?
৮. মায়ের গর্ভে ছিল না এমন চারটি জিনিস কী কী?
৯. কোন্ জিনিস শ্বাস নেয়, কিন্তু তার জীবন নেই?
১০. কোন্ সফরকারী কেবল একবার সফর করেছে?
১১. কোন্ বৃক্ষের নিচে সফর করলে সফরকারী ১০০০ বছরেও এর ছায়া পার হতে পারবে না?
১২. কোন্ জমিনের ওপর সূর্য মাত্র একবারই কিরণ দিয়েছিল?
১৩. পানি দেয়া ছাড়া কোন্ গাছ জন্মেছিল?
১৪. বেহেশতে মানুষ পানাহার করবে, কিন্তু মলমূত্র ত্যাগ করবে না। পৃথিবীতে এর সদৃশ কিছু আছে কি?
১৫. বেহেশতে প্রতিটি খাদ্যপাত্রে বহুবর্ণধারী সুস্বাদু খাবার থাকবে; যদি পৃথিবীতে এর কোনো সদৃশ থাকে তাহলে সেটি কী?
১৬. বেহেশতে হুরিরা আপেলের মধ্য থেকে বের হয়ে আসবে এবং সেই আপেল অক্ষত থাকবে। এই পৃথিবীতে এর সদৃশ কিছু আছে কি?
১৭. পৃথিবীতে যে দাসী দুইজন মালিকের অধীনে ছিল, কিন্তু আখেরাতে একজনের সাথে থাকবে সে কে (তার সদৃশ পৃথিবীতে কী রয়েছে)?
১৮. বেহেশতের চাবি কী?
এখন ইমাম আলী (আ.) যে উত্তর লিখেছিলেন তা উল্লেখ করা হলো :
ইমাম আলী (আ.) লিখলেন : ‘হে সম্রাট ! আমি আপনার চিঠি পড়েছি এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্যে ও তাঁর পবিত্র নবীর আশীর্বাদে আমি আপনার প্রশ্নগুলোর জবাব দিচ্ছি।’
১. সম্রাট যে বিষয়টি জানেন না তা হলো খ্রিস্টানরা যা তাঁর ওপর আরোপ করে; আর তা হলো আপনারা বলেন যে, আল্লাহর একজন ছেলে আছে, স্ত্রী আছে ও অংশীদার রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর এগুলোর কিছুই নেই।
২. আল্লাহর যা নেই তা হলো জুলুম (অবিচার), যেহেতু তিনি তাঁর গ্রন্থে ঘোষণা করেছেন : ‘আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অবিচারক নন।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৮২, সূর আনফাল : ৫১, সূরা হজ : ১১০)
৩. আগুন, এটি মুখসর্বস্ব, যে কোন জিনিস যে কোনো দিক থেকে এর মধ্যে রাখা হোক না কেন তা খেয়ে ফেলে।
৪. পানি, এটি পা’সর্বস্ব।
৫. সূর্য, এটি চোখসর্বস্ব।
৬. বাতাস, এটি ডানাসর্বস্ব।
৭. আদম (আ.), তাঁর কোন পূর্বসূরি নেই।
৮. যেগুলো মায়ের গর্ভে ছিল না সেগুলো হলো- মূসা (আ.)-এর লাঠি, ইবরাহীম (আ.)-এর দুম্বা, হযরত আদম (আ.) ও হযরত হাওয়া (আ.)।
৯. প্রভাতের জীবন নেই, যদিও শ্বাস নেয়, যেমনটি মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বর্ণনা করেছেন : (সূরা তাকভীর : ১৮)
১০. যে সফরকারী একবার মাত্র সফর করেছিল তা হলো সীনাই পর্বত। এটি সেই সময়ে ঘটেছিল যখন অবাধ্য ইসরাইলিরা তাদের নবীর বিরোধিতা করেছিল। সেই পবিত্র ভূমি ও সিনাই পর্বতের মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান ছিল। আল্লাহ সেই পর্বতকে দ্বিখণ্ডিত করে সেই বিদ্রোহী জনগোষ্ঠীর ওপর ছাদের মতো করে তুলে ধরেছিলেন। সেই নবী তাদেরকে বিশ্বাসে প্রত্যাবর্তনের দিকে আহ্বান জানান, অন্যথায় পাহাড় তাদের ওপর পতিত হবে। যখন সেই জনগোষ্ঠী অনুশোচিত হলো তখন তিনি সেই পর্বতকে তার মূল জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যান। (সূরা আরাফ : ৭১)
১১. এই বৃক্ষটি হলো তুবা বৃক্ষ। এর ছায়া এতটাই বিস্তৃত যে, যদি একজন ব্যক্তি এর নিচে হাজার বছর পথ চলে তাহলেও সে এর ছায়া থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না। একে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ও বলা হয় এবং এটি সপ্তম আসমানের ওপর অবস্থিত। এটি সেই স্থান যেখানে আদমসন্তানদের কর্মসমূহ সংরক্ষিত রয়েছে। এটি বেহেশতের অন্যতম বৃক্ষ। এই বৃক্ষের ডাল পালা এত লম্বা ও বিস্তৃত যে, এটি বেহেশতের সকল বাসস্থানে পৌঁছায়। এটি এই পৃথিবীর সূর্যের মতো; এটি কেবল একটিই, কিন্তু এর আলো সর্বত্র পৌঁছে।
১২. যে স্থানের ওপর সূর্য মাত্র একটিবার কিরণ দিয়েছিল তা ছিল লোহিত সাগরের তলদেশ, যখন মূসা (আ.) এবং তাঁর সাথিরা তা অতিক্রম করে অন্য পাড়ে চলে গিয়েছিলেন যখন ফিরআউনের সৈন্যবাহিনী তাঁদের পশ্চাদ্ধাবন করেছিল। আল্লাহ পানিকে দু’ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছিলেন এবং প্রতিটি ভাগকে পাহাড়ের মতো মনে হচ্ছিল। সমুদ্র তলদেশ রৌদ্রতাপে সম্পূর্ণরূপে শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল এবং যখন ইসরাইলিরা পানি অতিক্রম করে গিয়েছিল তখন পানি আবার এর ওপর প্রবাহিত হয়েছিল।
১৩. যে গাছটি পানি ছাড়া জন্মেছিল তা ছিল হযরত ইউসুফ (আ.)-এর লাউ গাছ, যেমনটি আল্লাহ কোরআনে বর্ণনা করেছেন : ‘আমি তার ওপর এক লতাবিশিষ্ট বৃক্ষ উদ্গত করলাম।’ (সূরা সাফ্ফাত : ১৪৬)
১৪. বেহেশতী খাবারের সদৃশ হলো মায়ের পেটে ভ্রুণ যে খাদ্য মা থেকে গ্রহণ করে, এটি তার নাভির মাধ্যমে খাদ্য গ্রহণ করে, কিন্তু এর কোন মলমূত্র নেই।
১৫. এই পৃথিবীতে বেহেশতী বহুবর্ণধারী খাদ্যের উদাহরণ হলো ডিম। এর দুটি রঙ হলুদ ও সাদা স্বাভাবিক অবস্থায় কখনো একে অপরের সাথে মিশ্রিত হয়ে যায় না।
১৬. আপেলের মধ্য থেকে হুর বের হওয়া এবং আপেলের অক্ষত থাকার সদৃশ এই পৃথিবীতে হলো সেই ফল যার মধ্য হতে কোন কোন কীট বের হয়ে আসে, কিন্তু ফলের ভেতরের উপাদানের কোন ক্ষতি সাধিত হয় না।
১৭. দুই ব্যক্তি কর্তৃক অধিকৃত সেই দাসী যে আখেরাতে একজনের সাথে থাকবে- এই পৃথিবীতে তার দৃষ্টান্ত হলো খেজুর গাছ যা এই পৃথিবীতে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী কর্তৃক সমভাবে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু আখেরাতে এটি বিশ্বাসীদের জন্য থাকবে, কারণ, খেজুর গাছের কথা কেবল বেহেশতের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যেখানে কাফেররা তাদের অবিশ্বাসের কারণে সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না।
১৮. বেহেশতের চাবি হলো এই বাক্যÑ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।
বর্ণিত হয়েছে যে, যখন রোমের বাদশাহ এই চিঠি পাঠ করলেন তখন তিনি আশ্বর্যান্বিত হয়ে বললেন : ‘এই পত্রের লেখক নিশ্চয়ই মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের একজন হবেন, কারণ, মহানবীর নিকটজন ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম নয়।’
এরপর তিনি দূতকে জিজ্ঞেস করলেন : ‘তুমি বল, কে আমার এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছে?’
দূত জবাব দিলেন : ‘তিনি মহানবী (সা.)-এর চাচাতো ভাই।’
এরপর রোমের বাদশাহ ইমাম আলীর কাছে একটি পত্র প্রেরণ করেন। তিনি লেখেন : ‘আসসালামু আলাইকুম। আমি আমার প্রশ্নগুলোর জবাব পড়েছি এবং এই প্রত্যুত্তর আমাকে এটি অনুভব করিয়েছে যে, আপনি মহানবী (সা.)-এর পরিবার থেকে এবং একটি পুণ্য-জ্ঞান এবং সাহসিকতার আলোকিত রত্ন। এখন আপনি আমাকে সত্যপথ সম্পর্কে অবহিত করুন। আরো বলুন যে, রূহ অর্থ কী- যেটি সম্পর্কে কোরআনে একটি আয়াতে বলা হয়েছে :
‘আর তারা আপনাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দিন : রূহ আমার পালনকর্তার আদেশ ঘটিত।’-(সূরা বনি ইসরাইল : ৮৫)
ইমান আলী জবাব দেন : ‘জেনে রাখুন যে, রূহ হলো সৃষ্টির সবচেয়ে সূক্ষ্ম দিক এবং আলোর সর্বোচ্চ ধরন। এটি সর্বশক্তিমান ও পরম স্রষ্টার একটি অলৌকিক বিষয়। যিনি তাঁর গুপ্ত ভান্ডার থেকে একে বের করেছেন এবং উন্মুক্তভাবে তাঁর রাজত্বে তাঁর সৃষ্টিরাজির সামনে উপস্থাপন করেছেন। এটি তাঁর কাছে আপনার মুক্তির একটি উপকরণ। এটি আপনার কাছে তাঁর একটি আমানত। রূহের মাধ্যমে আপনি আল্লাহর যেসব অনুগ্রহ পেতে চান তা পেতে পারেন। আর তিনি তাঁর এই আমানত আপনার কাছ থেকে ফিরিয়েও নেবেন। ওয়াস্সালাম।’
সূত্র : তাযকিরাহ খাওয়াসুল উম্মাহ, আল্লামা সিবতে ইবনে যাওজী।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ : মো. আশিফুর রহমান