বিশ্বমানবতার প্রতি মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর অবদান
পোস্ট হয়েছে: নভেম্বর ৩০, ২০১৭
ড. আদিল বিন আলী আশ-শাদ্দী.মানবতার মুক্তিদূত মহানবী (সা.)-এর পরিচিতি তুলে ধরার আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামের দায়িত্ববোধ থেকে আমরা মনে করেছি যে, আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মানবতা ও বিশ^কে কী দিয়েছেন সে সম্পর্কে যত ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়ে থাকে তার জবাব দেয়া আমাদের ওপর কর্তব্য।
এ ক্ষেত্রে আমরা মহানবী (সা.) বিশ^মানবতাকে কী দিয়েছেন, সে সম্পর্কে ১০টি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে চাই।সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য এবং রহমত ও শান্তিধারা বর্ষিত হোক সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওপর।
কতিপয় পশ্চিমা অমুসলিম প্রশ্ন তুলেছেন যে, হযরত মুহাম্মাদ (মুস্তফা সা.) বিশ^মানবতাকে কী দিয়েছেন। বিশেষ করে পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমে তাঁর পূতঃপবিত্র চরিত্রের ওপর কলঙ্ক আরোপের চেষ্টার পর তারা এ প্রশ্নটি উত্থাপন করছে।
এই আলোচনাকে সংক্ষেপে এভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে।
- মহান আল্লাহর পক্ষ হতে ওহী লাভ করার পর হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মানবজাতিকে অন্য মানুষের আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ থেকে মুক্ত করে মানুষকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর সামনে সমর্পিত হওয়ার দিকে ধাবিত করেছেন। আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে অংশীদার সাব্যস্ত করা থেকে মানুষের চিন্তা-বিশ^াস ও আচরণকে মুক্তি দিয়েছেন। এর ফলে মানবজাতি আল্লাহ ব্যতীত অন্য সবকিছুর দাসত্ব হতে মুক্তি লাভ করেছে। এটিই হচ্ছে মানবজাতিকে দেয়া সবচেয়ে বড় সম্মান ও গৌরব।
- মহান আল্লাহর পক্ষ হতে আদিষ্ট হয়ে মহানবী (সা.) মানুষের চিন্তা ও বিশ^াসকে কুসংস্কার, প্রতারণা, মিথ্যা বস্তু বা বিষয়ের পূজা ও অর্চনা এবং একই সাথে যুক্তি ও বুদ্ধির সাথে সাংঘর্ষিক চিন্তাধারা থেকে মুক্ত করেছেন। যেমন এই ধারণা পোষণ করা যে, আল্লাহর একজন পুত্র আছেন এবং তিনি মানুষের পাপ মোচনের জন্য নিজেকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়েছেন।
- হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মানুষের মাঝে সহনশীলতার ভিত্তি রচনা করেছেন। কুরআন মজীদে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী (সা.)-র কাছে ওহী পাঠিয়েছেন যে, ধর্মমত গ্রহণের বেলায় কারো ওপর জোরজবরদস্তি করা যাবে না। অনুরূপভাবে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যেসব অমুসলিম মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত নয়, তাদের অধিকারসমূহও সাব্যস্ত করে দিয়েছেন, তিনি তাদের নিজেদের, তাদের সন্তানদের এবং তাদের সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা বিধান করেছেন। এমনকি আজকের দিনেও অনেক মুসলিম দেশে ইহুদি ও খ্রিস্টান নাগরিকরা পূর্র্ণ শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে বসবাস করছেন। অথচ আমরা এর বিপরীতে স্পেনের ইতিহাসে দেখি যে, একটি জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালিয়ে সেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করা হয়েছে, যার মাধ্যমে খোদ পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে বিবৃত মানবাধিকারের সকল মূলনীতি পদদলিত করা হয়েছে।
- মুহাম্মাদ (সা.) হচ্ছেন আল্লাহর পক্ষ হতে রহমত ও অনুগ্রহ যাঁকে আল্লাহর পক্ষ হতে মানুষের বিশ^াস ও বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র জগতবাসীর প্রতি পেরণ করা হয়েছে। বাস্তবেই তাঁর শিক্ষাসমূহ এমনকি পশুপাখিকেও শান্তি ও অনুগ্রহের ছায়াতলে শামিল করে। এই শিক্ষা পশুপাখিকে অন্যায়ভাবে ও অকারণে হত্যা কিংবা আঘাত করাকেও নিষেধ করে।
- হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর পূর্বে যেসব নবী-রাসূল দুনিয়াতে এসেছিলেন, তাঁদের প্রতি অতুলনীয় সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন হযরত আদম, মূসা ও ঈসা (তাঁদের সবার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক)। আল্লাহ তা‘আলা ওহীর মাধ্যমে তাঁকে একথাও নির্দেশ করেছেন যে, কেউ যদি কোনো একজন নবীকেও অস্বীকার কিংবা অসম্মান করে তাহলে সে মুসলমান হতে পারবে না। ইসলাম সকল নবীকে একই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের আওতায় বিবেচনা করে। মানুষকে এই বিশ্বাসের প্রতি আহ্বান জানায় যে, একমাত্র মহান একক সত্তা আল্লাহ ছাড়া উপাসনা পাওয়ার যোগ্য আর কেউ নয়।
- মহানবী (সা.) নারী-পুরুষ, যুবক, বৃদ্ধ তথা সামাজিক মর্যাদা নির্বিশেষে সবার জন্য মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করেছেন। তিনি কতিপয় মহিমান্বিত মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করেছেন, যার একটি উদাহরণ হল, তাঁর জীবনের সর্বশেষ হজের সময় তিনি মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের ওপর যে কোনো ধরনের সীমা লঙ্ঘনকে কঠোর ভাষায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি এসব মূলনীতি এমন সময় প্রবর্তন করেছিলেন, যা ছিল ১২১৫ সালের ম্যাগনাকার্টা, ১৬২৮ সালের মানবাধিকার ঘোষণা, ১৬৭৯ সালের ব্যক্তি স্বাধীনতা আইন, ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা, ১৭৮৯ সালের মানব ও নাগরিক অধিকার চার্টার এবং ১৯৪৮ সালে মানবাধিকারের বিশ^জনীন ঘোষণার বহুকাল আগে।
- হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মানবজীবনে নৈতিকতার গুরুত্বকে সমুন্নত করেছেন। তিনি সুন্দর ব্যবহার, সততা, দায়িত্বশীলতা, পবিত্রতা এবং পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দায়িত্ব পালন করার মতো সামাজিক বন্ধনসমূহ মজবুত করার আহ্বান জানান। তিনি যা প্রচার করেছেন, তা বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। তিনি মিথ্যা, হিংসা, বিশ^াসঘাতকতা, ব্যভিচার, পিতামাতার অবাধ্যতা ও অসম্মান প্রভৃতি অসৎ আচরণের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন এবং তা নিষেধ করেছেন। তিনি এসব সামাজিক ও নৈতিক ব্যাধি থেকে যেসব রোগের উৎপত্তি হয় তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন।
- মহানবী (সা.) তার ওপর নাযিলকৃত বাণীর মাধ্যমে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে নিজের চারপাশের পৃথিবীকে উদ্ঘাটন করার জন্য তার মন ও চিন্তাকে ব্যবহার করে এবং জ্ঞান অর্জন করে। তিনি এমন এক সময় এসব কাজের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে পুরস্কারের ঘোষণা দেন যখন অন্যান্য সভ্যতায় বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীরা বিজ্ঞানচর্চার অপরাধে ধর্মদ্রোহিতা ও ধর্মের অবমাননার অভিযোগে নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। অনেকে কারান্তরে নির্যাতিত হয়েছেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিহত হয়েছেন।
- মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর পক্ষ হতে এমন ওহী নিয়ে আসেন যার সকল শিক্ষা মানুষের স্বভাব-প্রকৃতির সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিশীল, যা তাদের আত্মিক চাহিদা ও দৈহিক প্রয়োজনের জন্য পুরোপুরি উপযোগী। একইভাবে তা তাদের ইহজাগতিক কাজকর্ম এবং পরজাগতিক উদ্দেশ্যে সম্পাদিত সকল কাজের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করে।
- ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা মানুষের সহজাত বৃত্তি ও আশা-আকাক্সক্ষাগুলোকে সম্পূর্ণ দমন করার পরিবর্তে এগুলোর মাঝে সমন্বয় ও শৃঙ্খলা বিধান করে। অথচ কোনো কোনো সংস্কৃতিতে মানুষের সহজাত চাহিদা ও আকাক্সক্ষাগুলোকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করার দীক্ষা দেয়া হয়, যা মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। যেমন ধর্মপ্রাণ লোকদেরকে বিবাহের যে সহজাত চাহিদা তা দমন করতে বলা হয়। একইভাবে বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে যে সহজাত প্রতিবাদী ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া থাকে তাকে অবদমিত করা হয়। একই সাথে তারা যাতে আগ্রাসনকারীর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখায় এবং যে কোনো পরিস্থিতিকে মেনে নেয় তার জন্য উৎসাহিত করা হয়।
- এর ফলে এসব সংস্কৃতি ও সভ্যতায় লালিত লোকদের অধিকাংশকেই ধর্মের শিক্ষাগুলো প্রত্যাখ্যান করতে এবং বস্তুবাদী ধ্যান ধারণার সাথে মিশে যেতে উৎসাহিত করা হয়। যার মধ্যে তাদের কেবল দেহই শান্তি ও সুখ অনুভব করতে পারে, অথচ তাদের আত্মা নিদারুণ যন্ত্রণায় হাহাকার করে।
- হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বিশে^র মাঝে মানুষে মানুষে সৌভ্রাতৃত্বের একটি যথার্থ মডেল উপস্থাপন করেছেন। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষের একে অপরের ওপর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কেননা, সৃষ্টিগতভাবে সবই সমান এবং দায়িত্ব ও অধিকারের ক্ষেত্রেও তারা সমান। পরস্পরের মধ্যে অগ্রাধিকার ও শ্রেষ্ঠত্বের একটিমাত্র মানদ- আছে, সেটি হল বিশ্বাস ও সৎভাবে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে অগ্রণী হওয়া। তাঁর যারা সাথি ও অনুসারী ছিলেন তাঁদেরকে ধর্মমত গ্রহণ ও পালনের ক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছিল। তাঁদের অন্যতম ছিলেন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রোমান বংশোদ্ভূত সোহাইল, আবিসিনিয় বংশোদ্ভূত বেলাল, পারস্য বংশোদ্ভূত সালমান এবং আরো অনেক অনারব। তাঁরাও সমান মর্যাদায় ভূষিত হয়েছিলেন।
উপসংহারে বলতে চাই যে, আমাদের আলোচ্য দশটি পয়েন্টের প্রত্যেকটির ব্যাখ্যা ও বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। বস্তুত হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মানবজাতিকে কী দিয়েছেন তা এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় যা এসেছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের গবেষক যাঁরা এই মহান নবীর জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে বিষয়ভিত্তিক গবেষণা করেছেন, তাঁদের পক্ষ হতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে।
বিস্তারিত জানার জন্য দয়া ও অনুগ্রহের আধার মহানবী (সা.)-এর পরিচিতি তুলে ধরার আন্তর্জাতিক প্রোগামের পক্ষ হতে পরিচালিত এই ওয়েব সাইট ভিজিট করার আমন্ত্রণ রইল: www.mercyprophet.com
আল্লাহর দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও অন্যান্য নবী-রসূলদের প্রতি, মহানবীর পরিবার, বংশধর, তাঁর সাহাবী ও অনুসারীদের প্রতি।
http://en.islamway.net/article/13711/what-prophet-muhammad-gave-to-humanity
লেখক : সেক্রেটারি জেনারেল
মহানবী (সা.)-এর পরিচিতি তুলে ধরার আন্তর্জাতিক প্রোগ্রাম
অনুবাদ: ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী