বৃহস্পতিবার, ৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

বিশ্বব্যাপী সৌরভ ছড়াচ্ছে ইরানের গোলাপজল উৎসব

পোস্ট হয়েছে: মে ২৩, ২০১৭ 

news-image
মে মাসের শুরু থেকে জুনের মাঝামাঝি। মধ্য ইরানের কাশান এবং এর আশপাশের শহর ও গ্রামগুলো যেন সাজে অপরূপ প্রাকৃতিক রূপে। সাদালাল আর গোলাপি গোলাপের পাশাপাশি নানা প্রজাতির ফুল তৈরি করেছে নয়নাভিরাম দৃশ্য। সেখানে পা ফেলতেই যেন চার দিক থেকে বাতাশে ভেসে আসে ম-ম সুমিষ্ট ঘ্রাণ। মুহূর্তেই জুড়ে যায় মন।
 
উৎসব হোক বা শোকসব জায়গাতেই পবিত্রতার প্রতীক গোলাপজল। এমনকি খাবারওষুধ এবং রূপচর্চায়ও ব্যবহৃত হয় এই উপকরণটি। আর গোলাপ জল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ইরান। এর মন মাতানো সৌরভ শুধু ইরানেই নয় ছড়িয়ে গেছে বিশ্বব্যাপী।
প্রতিবছর মে এর শুরু থেকে জুনের মাঝামাঝি সময়টা মধ্য ইরানে গোলাপ ফুল থেকে গোলাপজল প্রস্তুতিকরণের কার্যক্রম শুরু হয়। বসন্তকালীন গোলাপজল প্রস্তুতকরণের এই উৎসব ইরানিদের কাছেগোলাপ-গিরি’ নামে পরিচিত। গোলাপজল উৎসবকে ঘিরে এ সময়টায় মধ্য ইরানে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
আকাশ-বাতাশে ছড়িয়ে থাকা গোলাপের সুবাস মানুষের মন জুড়িয়ে দেয়। ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতেসুমিষ্ট ঘ্রাণ নিতে আশপাশের লোকজন তো ছুটে আসেই। দৃষ্টিনন্দন উৎসবের আকর্ষণে কাশান এবং এর আশপাশের শহর ও গ্রামগুলোতে ছুটে আসেন লাখ লাখ পর্যটক। ফুল বাগানের সৌন্দর্যে আর সুমিষ্ট ঘ্রাণে ব্যাকুল হন দর্শনার্থীরা।  
মূলত বাসা-বাড়িতে কিংবা বাগানে কিভাবে গোলাপের কুড়ি থেকে গোলাপজল বানানো হয় তা দেখতেই ছুটে আসেন উৎসুক জনতা। আর এ থেকেই কাশানের কামসারনিয়াসার ও বারজাক পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্যস্থলে পরিণত হয়েছে। এই শহরগুলোর প্রতিটি কোনায় যেন রঙের নৃত্য ছড়িয়ে আছে। বাতাসে ভেসে থাকা গোলাপের সুবাস মন মাতিয়ে তোলে।
ইরানের ইসফাহানকেরামান শাহফারস এবং পূর্ব আজারবাইজানের বিস্তীর্ণ বাগানে শুধুই চাষ হয় গোলাপ। শুধু সৌন্দর্য্ বর্ধনে নয়বাণিজ্যিক কারণেই এই লাল ও গোলাপি গোলাপের চাষ। উন্নতমানের এই গোলাপ থেকে হয় বিশ্বমানের গোলাপজল। সাগরপৃষ্ঠ থেকে ২ থেকে ৩ হাজার মিটার উচ্চতায় ঠাণ্ডা পরিবেশে লাল গোলাপ সবচেয়ে ভালো জন্মায় বলে জানান উৎপাদনকারীরা।
গোলাপজল প্রস্তুতকরণ:
গাছ থেকে গোলাপ ফুল তোলার আদর্শ সময় মধ্য মে থেকে জুন পর্যন্ত। এর আগে ফুলের রানী হিসেবে খ্যাত গোলাপ নজর কাড়ে পর্যটকদেরও। ইতিহাস বলে, ইরানে তৈরি গোলাপ জল আড়াই হাজার বছর আগে থেকেই দুনিয়াখ্যাত। গোলাব’ বা গোলাপজল হলো গোলাপের সুগন্ধি নির্যাস। যা বিভিন্ন ঐতিহ্যগত খাবারের সুঘ্রাণের জন্য দেশব্যাপী ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সুগন্ধি হিসেবেও এটা ক্রয় করা হয়।
গোলাপকে তাপ দিয়ে এর নির্যাস তৈরি করার প্রক্রিয়াটি বিজ্ঞানী ইবনে সিনার আবিষ্কৃত বলে মানা হয়। কারখানায় আনার পর পরিষ্কার করে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় দস্তার পাত্রে তাপ দেয়া হয় ফুলের পাপড়ি ও কুঁড়িকে। এর থেকে যে নির্যাস বের হয় তা দিয়েই তৈরি হয় উন্নতমানের গোলাপ জল।
অনেকে মনে করেন, ফ্যাক্টরিতে গোলাপ জল উৎপাদনের চেয়ে ঐতিহ্যগতভাবে বাসাবাড়ি ও বাগানে যেভাবে গোলাপজল প্রস্তুত করা হয় তার মান অনেক ভালো। কেননা, ঐহিত্যবাহী এ পদ্ধতিতে গোলাপ ফুল সংগ্রহ ও তা থেকে গোলাপজল প্রস্তুতকরণের মাঝে খুবই কম সময় ব্যয় হয়। ফলে গোলাপজলের মানও ভালো হয়।
ইরানের ফুল ও গাছ-গাছড়ার নির্যাস প্রস্তুতিকরণের গভীর ইতহাস রয়েছে। গোলাপজল অত্যন্ত মিষ্টি সুগন্ধি সম্পন্ন ফুল থেকে তৈরি করা হয়। ইরানে এসব ফুল মোহাম্মাদ গোলাব’ নামে অধিক পরিচিত। বুটি গোলাপ থেকেই বেশিরভাগ গোলাপজল ও গোলাপ তেল উৎপাদন করা হয়।
বাগান থকে বুটি গোলাপ ফুল তোলা কিছুটা নিবিড় প্রকৃতির কাজ। ভোর থেকে সকালএই সময়টা গোলাপ ফুল তোলার আদর্শ সময়। ফুল সংগ্রহ ও তা থেকে নির্যাস প্রস্তুতকরণের মাঝে পরিবহনে বিলম্ব হলে গোলাপজলের পরিমাণ ও মান উভয়ই কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে গোলাপ জল নিষ্কাশন করতে প্রথমে গোলাপের পাপড়ি জড়ো করা হয়। পরে তা বিশাল একটি ধাতব পাত্রে রাখা হয়। এরপর ধাতব পাত্রটি ঐহিত্যগতভাবে ইটপাথর ও কাঁদা দিয়ে তৈরি ওভেনের ভেতরে রাখা হয়।
প্রতিটি পাত্রে ৩০ কেজি গোলাপের পাপড়ির সঙ্গে ৮০ লিটার পানি ঢালা হয় এবং চলন্ত বাষ্প সঞ্চালনের জন্য ওই পাত্রের সঙ্গে ধাতব পাইপের সংযোগ দেয়া থাকে। এ পাইপ দিয়ে ওভেনে হাইড্রোসল ঢুকে। এভাবেই তৈরি হয় গোলাপজল। অন্যদিকেনিষ্কাশন প্রক্রিয়ার বর্জ পশুর খাবার অথবা মিশ্র সারের জন্য ব্যবহৃত হয়।
চিকিৎসাগত উপকার
কথিত আছে গোলাপের তেল ও গোলাপ জলের অনেক চিকিৎসাগত উপকার আছে। গোলাপের তেল মানুষের মনে বয়ে আনে স্বস্তি। দূর করে বিষণ্নতাদুঃখস্নায়ুবিক চাপ ও উত্তেজনা। পাশাপাশি ঠাণ্ডা নিরাময় ও ত্বক্বের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
 
গোলাপ জল ছাড়াও গোলাপ তেল ব্যবহৃত হয় সুগন্ধী এবং ওষুধ তৈরিতে। যার বেশির ভাগই রফতানি হয় ফ্রান্সে। আর এর এক বোতল কিনতে খরচ হবে ৮ থেকে ১০ হাজার ডলার।
রফতানি আয়:
সম্প্রতি কাশান শহরের গভর্নর হামিদ রেজা মোমেনিয়ান জানানকাশানে বছরে ২ হাজার টন গোলাপ জল ও তেল উৎপাদন হয়। তা রফতানি করে আয় হয় ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ গোলাপ জল ও তেল পারস্য ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও ইউরোপে রফতানি হয়।
৭ হাজার টন গোলাপ ফুল থেকে ২ হাজার টন গোলাপজল ও তেল উৎপাদন করা হয়। মধ্য ইরানে আড়াই হাজার হেক্টর গোলাপ বাগান থেকে আসে এসব গোলাপ।
সূত্র: তেহরান টাইমস।