বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে আরবি, ফারসি : প্রফেসর আব্দুল মান্নান
পোস্ট হয়েছে: এপ্রিল ২৬, ২০১৯
![news-image](https://www.iranmirrorbd.com/wp-content/uploads/2019/04/p2-3.jpg)
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আব্দুল মান্নান বলেছেন, প্রতিটি ভাষাই বিদেশি শব্দ দ্বারা সমৃদ্ধ হয়।বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলায় বিদেশি শব্দের ব্যবহার না থাকলে এই ভাষাটিও সংস্কৃত ভাষার মতোই একটি মৃত ভাষায় পরিণত হতো।বিদেশি ভাষা বিশেষকরে আরবি ও ফারসি এই ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। শুক্রবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার হলে আঞ্জুমানে ফারসি’র কাউন্সিল অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
অধ্যাপক মান্নান বলেন, আমার জন্মস্থান চট্টগ্রাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বশেষ অঞ্চল হলেও এটি ছিল বিভিন্ন ভাষাভাষীদের প্রবেশ পথ। যে পথে ব্যবসায়ীদের সাথে বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রবেশ ঘটেছে। তিনি বলেন, বঙ্গ ছিল এ অঞ্চলের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল। আর এখানে হাজার বছরের প্রাচীন বন্দর থাকায় এ পথ দিয়েই বেশিরভাগ বণিক এ অঞ্চলে প্রবেশ করতো। যে কারণে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় এখনও প্রচুর বিদেশি শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ফারসি এমন একটি ভাষা যা বিশ্বকে অনেক আন্তর্জাতিক মানের কবি,সাহিত্যিক উপহার দিয়েছে। এই ভাষাটি উপমহাদেশে দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল।এ অঞ্চলে এই ভাষাটির বিস্তারে আঞ্জুমানে ফারসির নব গঠিত কমিটি নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ রেযা নাফার। তিনি বলেন, এ অঞ্চলে ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতি বিস্তারের লক্ষ্যে গঠিত আঞ্জুমানে ফারসির এই কাউন্সিল অনুষ্ঠানে ফারসি ভাষাভাষীদের দেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত হিসাবে উপস্থিত থেকে নিজেকে ইতিহাসের অংশ করতে পারায় গৌরবান্বিত অনুভব করছি। আশাকরছি নতুন কমিটি আঞ্জুমানে ফারসির পথ চলাকে আরো বেগবান করবে।যারা অতীতে এই আঞ্জুমানের সাথে জড়িত থেকে মেধা ও সময় ব্যয় করেছেন তাদেরকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি যারা গত হয়েছেন তাদেরকেও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন রাষ্ট্রদূত রেযা নাফার।তিনি কবি শেখ সাদীর স্মরণ দিবসের কথা উল্লেখ করে বলেন, ইরানে যত বড় বড় কবি সাহিত্যিক রয়েছেন সাদী তাদের অন্যতম। গত ২১ এপ্রিল ফারসি পহেলা উর্দিবেহেশস্ত ছিল সাদীর স্মরণ দিবস। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো একে সাদী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।তার রচিত ফারসির ফুলবাগান খ্যাত ‘গুলিস্তান’ ও ‘বুস্তান’ এখনও সুবাস ছড়াচ্ছে।জাতিসংঘের প্রধান ফটকে লেখা তার কবিতা বিশ্বজুড়ে মানবতার বাণী ছড়াচ্ছে।সাদীর গজলের একটা বিরাট অংশ ইসলামের নবী, ও নবী পরিবারকে কেন্দ্র করে।আরেফদের জন্য মর্তবা, মহব্বত সাদীর কবিতার বিরাট অংশ প্রেমের গাথুনি দয়ে গ্রথিত। সাদী আমেরিকা ও ইউরোপে খুবই পরিচিত। পুশকিন, হুগো, ইমারসন সাদীর কবিতার প্রশংসা করেছেন।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর ড. কাযেম কাহদুয়ী ফারসি প্রেমিকদের সম্মান ও মর্যাদা কামনা করে বলেন,ইরান ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশে ফারসি ভাষার প্রচলন রয়েছে। তবে ইরানের ফারসি ও আফগানিস্তানে ব্যবহৃত ফারসি দারির মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি না সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুটি ভাষারই মূল উৎস একই। অর্থাৎ আরিয়ান ভাষা থেকে ফারসি ও ফারসি দারি উৎসারিত।তবে এই ভাষাটি নতুন নতুন রাষ্ট্রে এসে নতুন নতুন রূপ পায়।আর দারি ভাষাটির নামকরণ হয়েছে দরবারি ভাষা থেকে। তিনি বলেন, ইরানের ফারসি, ফারসি দারি ও ফারসি তাজিকের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য কেবল উচ্চারণগত।
অনুষ্ঠানে আঞ্জুমানে ফারসির সাবেক সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান বলেন, ইসলামের সূচনা হয়েছে আরেবে কিন্তু এ অঞ্চলে ইসলাম এনেছেন পারস্যের সুফি-সাধকরা। প্রায়৬৩৬ বছর এ অঞ্চলে ফারসি রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল।বাংলা ভাষার গবেষক ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেছেন, বাংলা ভাষায় প্রায় ৮ হাজার ফারসি শব্দ রয়েছে ।
এদেশের মাদ্রাসা শিক্ষায় দীর্ঘকাল ধরে ফারসি ভাষা পড়ানো হলেও পাকিস্তান আমলে এর গুরুত্ব কমে যায়। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় ধীরে ধীরে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা বাড়তে থাকে। বর্তমানে দেশের তিনটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ৩০ জন শিক্ষক ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রসারে কাজ করে যাচ্ছেন।তিনি কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও ত্রিশালে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ চালু করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সহায়তা কামনা করেন।
আঞ্জুমানে ফারসির সদ্য বিদায়ী সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবুল কালাম সরকার বলেন, দীর্ঘদিন পর আঞ্জুমানে ফারসির পুনরুজ্জীবনে সহযোগিতার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ফারসির বিস্তার ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি বিভাগ চালু করার ব্যাপারে যে দাবি উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সহায়তায় তা আলোর মুখ দেখবে বলে আমি আশাবাদী।
অনুষ্ঠানে ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কালচারাল কাউন্সেলর ড. মাহদী হোসেইনী ফায়েক বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর এ অঞ্চলে ফারসি চর্চা নতুন মাত্রা পায়। কালচারাল সেন্টারের প্রধান পৃষ্ঠপোষকতায় আঞ্জুমানের নতুন কমিটির র্নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন,ফারসির উন্নয়নের জন্য এ অনুষ্ঠান মাইল ফলক হয়ে থাকবে। অতীতে যারা আঞ্জুমানে ফারসির নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশেষকরে অধ্যাপক সিরাজুল হক, ড. কুলসুম আবুল বাসার, ড.মাহবুবুর রহমান, মরহুম ফরিদ উদ্দিন খান, ড. সাইফুল ইসলাম খান, আবুল কালাম সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে ড. মাহদী ফায়েক বলেন ফারসি ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পক্ষ থেকে অতীতের মত সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে ।
আলোচনা পর্ব শেষে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। নতুন কমিটির সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন বিশিষ্ট লেখক, সাহিত্যিক ও ফারসি গবেষক ড. ঈসা শাহেদী, সহ সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মহসিন উদ্দিন মিয়া ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের ফারসি বিভাগের শিক্ষক শামীম বানু, যুগ্ম সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আহসানুল হাদী, কোষাধ্যক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের ফারসি বিভাগের শিক্ষক এ্যাডভোকেট কামাল হোসাইন, প্রচার সম্পাদক আহসানিয়া ইন্সটিটিউট অফ সুফিজম এর সহকারী অধ্যাপক শেইখ মোহাম্মদ ওসমান গণি, প্রকাশনা সম্পাদক ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, অনুবাদ ও গবেষণা সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মেহেদি হাসান ও অফিস সম্পাদক মোহাম্মদ ইব্রাহিম।সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন জামিয়াতুল মোস্তফা বিশ্ববিদ্যালযের শিক্ষক শাহনাজ আরেফিন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আতাউল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক ড. সিদ্দিকুর রহমান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান ড. নূরে আলম ও ঢাকাস্থ ইরানিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল আব্দুল কুদ্দুস বাদশা। অনুষ্ঠানে ফারসি নাত পরিবেশন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মেহেদি হাসান।অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সবুর খান।
![](https://www.iranmirrorbd.com/wp-content/uploads/2019/04/p13.jpg)