বুধবার, ৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

English

পুরাতন ও নতুন টেস্টামেন্টে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)

পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৬ 

news-image

ইবরাহীম মুদিব্বো (নাইজেরিয়া) : প্রত্যেক নবীই তাঁর উম্মতের কাছে ঘোষণা করতেন যে, তাঁর পরে আরো নবী আসবেন। শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম। কেননা, তাঁর পরে মানব সমাজের উদ্দেশ্যে আল্লাহর তরফ থেকে নবী প্রেরণ চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

নূহ (আ.) থেকে হযরত মারইয়ামের পুত্র ঈসা (আ.) পর্যন্ত সকল নবীকেই শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আগমন এবং তিনি যে বাণী নিয়ে আসবেন তা বিশ্বাস করতে তাঁদের উম্মতদেরকে বলার জন্য খোদায়ী নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ঐ বাণীতে পূর্ববর্তী সকল অহী বা প্রত্যাদেশের সত্যতার স্বীকৃতিও দান করা হয়েছিল।

শেষ নবীর আগমন সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণী ইহুদি ও খ্রিস্টধর্ম শাস্ত্রের পুরাতন ও নতুন উভয় টেস্টামেন্টেই পাওয়া যায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, মহানবী (সা.) যখন মানুষের উদ্দেশে আল্লাহর শেষ বাণী বা প্রত্যাদেশ নিয়ে আগমন করেন তখন ঐ সব ধর্মানুসারী লোক বিদ্বেষ ও ঔদ্ধত্যবশত তাঁকে সত্য বলে মেনে নিতে এবং নবী হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়।

সকল মানবগোষ্ঠীর মধ্যে ইহুদি জাতিই সবচেয়ে দীর্ঘ নবুওয়াতী ধারা পেয়েছে। মূসা (আ.), সোলায়মান (আ.), দাউদ (আ.), ইয়াহইয়া ও ঈসা (আ.) সহ আল্লাহর মহান নবীদের সকলেই ছিলেন ইহুদি গোত্রভুক্ত এবং বিশেষভাবে তাঁরা ইহুদিদেরকে হেদায়াত করার জন্যই প্রেরিত হয়েছিলেন। কিন্তু একটি বিদ্রোহী জনগোষ্ঠী হিসেবে তারা এসব নবীর কাউকে কাউকে প্রত্যাখ্যান করে এবং হত্যা করতে উদ্যত হয়।

আল্লাহ তাআলা ফিরআউনকে সতর্ক করে দেয়ার জন্য হযরত মূসা (আ.)-কে প্রেরণ করেছিলেন যেন সে ইসরাইলের সন্তানদেরকে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়। কেননা, ফিরআউন ঐ সমাজের পুরুষদেরকে দিয়ে কঠোর পরিশ্রম করাতো, তাদেরকে অপমান ও হত্যা করত এবং নারীদের দাসী বানিয়ে রাখত। ফিরআউন আল্লাহর নবীর বাণী কর্ণপাত করতে অস্বীকৃতি জানালে নীল নদে তাকে ডুবে মরতে হয় এবং ইসরাইলের বংশধররা নিরাপদে সমুদ্র অতিক্রম করে যায়। বহুবার তারা হযরত মূসা (আ.)-কে অমান্য করে, অথচ মূসা (আ.) চেয়েছিলেন তাদেরকে বন্ধনমুক্ত করতে।

হযরত যাকারিয়া (আ.) এবং ইয়াহইয়া (আ.) যখন সত্যবাণী প্রচার শুরু করেন তখন লোকেরা তাঁদেরকে মিথ্যাবাদী হিসেবে বিবেচনা করে এবং পরে উভয়কেই হত্যা করে। পরবর্তীকালে ঐ আহলে কিতাবের অনুসারীরা শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর বিরুদ্ধাচরণ করে এবং তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে। এতে অবশ্য বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। অথচ তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে তাঁর আগমনের কথা আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল।

আল্লাহ তাআলা যখন প্রকাশ করেন যে, শেষ নবী হবেন সকল নবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ নবী এবং তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবেন না, কিন্তু শেষ নবীর এই দাওয়াত চালু থাকবে একেবারে শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত; তখন তারা আশা করেছিল যে, শেষ নবী আগমন করবেন তাদের মধ্য থেকেই।

কিন্তু যখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে আরবদের মধ্য থেকে বাছাই করলেন তখন তারা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে। ইহুদি ও আরবরা ছিল পরস্পর আত্মীয়। ইহুদিরা নবী ইয়াকুব (আ.)-এর বংশধর এবং আরবরা নবী ইসমাঈল (আ.)-এর বংশধর, আর এতদুভয়ই ছিলেন নবী ইবরাহীম (আ.)-এর পুত্র।

অবশ্য, অন্যান্য নবী যেমন কোনো বিশেষ জাতি বা উপজাতির উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন, শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কিন্তু তেমনভাবে প্রেরিত হননি। শেষ নবী আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত হয়েছিলেন সমগ্র মানবসমাজের অর্থাৎ আরব, ইহুদি, অ-ইহুদি তথা সকল জাতি-উপজাতির উদ্দেশ্যে। তাঁর বাণী চিরন্তন এবং সূর্যসদৃশ, যা সর্বক্ষণ কিরণ দিয়ে চলেছে।

পুরাতন টেস্টামেন্টে আছে, মূসা (আ.) শেষ নবী প্রেরণের ব্যাপারে আল্লাহর প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়ে ইসরাইলীদেরকে বলেছেন : ‘আমি তাদের ভাইদের মধ্য থেকে তোমার মতো একজনকে নবী মনোনীত করব এবং আমি তার মুখে আমার কথা স্থাপন করব এবং আমি তাকে যে আদশে দিয়েছি সে সকলের কাছে তা বলবে।’ (Deuteronomy, 18 : 18)

এই গুরুত্বপূর্ণ উক্তিটি আমাদেরকে মহানবী (সা.)-এর পরিচয় হযরত মূসা (আ.)-এর ব্যক্ত ধারণার অনুরূপ বলে প্রমাণ করে। কেউ কেউ দাবি করে যে, এটি মারইয়ামপুত্র ঈসা (আ.)-এর ওপর বর্তায়। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্যাদিতে এটা প্রমাণিত হয় যে, এই দাবি সঠিক নয়। মূসা (আ.) ও ঈসা (আ.)-এর মধ্যে একমাত্র অভিন্নতা হলো তাঁরা উভয়ে আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে ইসরাইলীদের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন। এই অভিন্নতা দাউদ (আ.), সোলায়মান (আ.) এবং ইয়াহইয়া (আ.)-এর মতো অন্যান্য ইহুদি বংশোদ্ভূত নবীর মধ্যেও পাওয়া যাবে।

অবশ্য মূসা (আ.) ও মুহাম্মাদ (সা.)-এর মধ্যে আরো অনেক চমতকার অভিন্নতা বিদ্যমান যা অন্য কোনো নবীর ক্ষেত্রে দেখা যায় না। যেমন প্রথমত হযরত মূসা (আ.) ও হযরত মুহাম্মাদ (সা.) উভয়েরই মাতা-পিতা ছিলেন, কিন্তু হযরত ঈসা (আ.)-এর কেবল মাতা ছিলেন।

দ্বিতীয়ত মূসা (আ.) ও মুহাম্মাদ (সা.) উভয়েই তাঁদের মিশনে সফল হন। আর আধ্যাত্মিক জগতের সাথে সাথে তাঁরা পার্থিব জগতও নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁরা তাঁদের জনগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছিলেন। কিন্তু ঈসা (আ.)-কে জনসাধারণ মেনে নেয়নি এবং তাঁকে ক্রুশে বিদ্ধ করে হত্যার চিন্তা করা হয়।

তৃতীয়ত মূসা (আ.) ও মুহাম্মাদ (সা.) উভয়েই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু হযরত ঈসা (আ.) বিবাহিত ছিলেন না।

চতুর্থত মূসা (আ.) ও মুহাম্মাদ (সা.) উভয়েই স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁদেরকে পবিত্র কবরগাহে দাফন করা হয়। কিন্তু ঈসা (আ.)-কে দৈহিক ও আত্মিকভাবে ঊর্ধ্বে তুলে নেয়া হয়।

পঞ্চমত মূসা (আ.) ও মুহাম্মাদ (সা.) উভয়েই তাঁদের উম্মতদের জন্য নতুন শরীয়ত বা বিধান নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু ঈসা (আ.) কোনো নতুন বিধান নিয়ে আসেননি, যে জন্য তিনি বলতেন : ‘মনে করো না যে, আমি শরীয়তকে ধ্বংস করতে এসেছি; বরং তা পূর্ণ করতে এসেছি।’ (ম্যাথিউ, ৫ : ১৭)

নতুন টেস্টামেন্টের যুক্তি অনুসারেও মূসা (আ.) ও ঈসা (আ.)-এর মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্যহীনতা লক্ষ্য করা যায়।

খ্রিস্টধর্মের ত্রিত্ববাদ অনুসারে মূসা (আ.) নয়, ঈসা (আ.)-কে খোদার জন্ম দেয়া পুত্র এবং এমনকি স্বয়ং ঈসা (আ.)-কেও খোদা বলে (নাউযুবিল্লাহ) আখ্যায়িত করা হয়েছে।

শেষ নবীর আগমন সম্পর্কে ইসরাইলদের অবহিত করার কাজ কেবল মূসা (আ.) একা করেননি। জনের গসপেলে (খ্রিস্টের উপদেশাবলি) বলা হয়েছে যে, ঈসা (আ.) ইসরাইলীদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন : ‘কিন্তু আমি তোমাদেরকে এই সত্য বলছি, আমার বিদায় নেয়াই উত্তম, কেননা, আমি বিদায় গ্রহণ না করলে তোমাদের কাছে সাহায্যকারী (শেষ নবী) আসবেন না।’ (জন : ১৬ : ৭)

একইভাবে জনের গসপেলে ঈসা (আ.) আরো বলেন : ‘তোমাদেরকে আমার আরো অনেক কিছু বলার আছে, কিন্তু না, তা তোমাদের বহন করার ক্ষমতার চেয়ে বেশি হবে। অবশ্য, যখন রুহ (শেষ নবী) আগমন করবেন, তখন তিনি খোদা সম্পর্কে সকল সত্য প্রকাশ করবেন। তিনি তোমাদের সকলকে সত্যের দিকে নিয়ে যাবেন। তিনি তোমাদেরকে নিজের থেকে কিছু বলবেন না। বরং তিনি তোমাদেরকে তাই বলবেন যা তিনি শুনে থাকবেন এবং তিনি তোমাদেরকে ভবিষ্যত সম্পর্কেও অবহিত করবেন।’ (জন : ১৬ : ৭)

ঈসা (আ.) ইসরাইলীদেরকে শেষ নবীর আগমন সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন। যে শেষ নবী খোদার আদেশ মোতাবেক মূসা ও ঈসার ধর্মে (পুরাতন ও নতুন টেস্টামেন্ট) বিশ্বাসীদের সামনে ‘খোদার সত্য পরিচয়’ যথাযথভাবে তুলে ধরে তাদেরকে এক খোদার ইবাদত করার এবং তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক না করার আহ্বান জানান : ‘তুমি বল : হে কিতাবিগণ! এস সে কথায় যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই; যেন আমরা আল্লাহ ব্যতীত কারো ইবাদত না করি, কোনো কিছুকেই তাঁর শরীক না করি।’ (সূরা আলে ইমরান : ৬৪)

ঈসা (আ.) সত্য কথাই বলেছেন যে, শেষ নবী ‘নিজের তরফ থেকে বলেন না’; বরং খোদার তরফ থেকে ‘তিনি যা শুনে থাকেন’ তাই বলেন- যেমন উপরোল্লিখিত আয়াতটি।

পবিত্র কুরআনের সবটুকুই শেষ নবী (সা.)-এর মুখ দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে।

ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) পবিত্র কুরআনের প্রতিটি শব্দ মহানবী (সা.)-কে শুনিয়েছেন এবং মহানবী (সা.) স্মৃতিপটে ধারণ করেছেন এবং যেভাবে শুনেছেন হুবহু তা তাঁর সাহাবাদের কাছে ব্যক্ত করেছেন। পবিত্র কুরআনের কতকগুলো আয়াত শুরু হয়েছে খোদার তরফ থেকে সরাসরি আদেশ দিয়ে, যেমন ‘বল’।

আবার, ঈসা (আ.) শেষ নবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ পবিত্র কুরআন সম্পর্কে এ সত্যও প্রকাশ করেছেন যে, তা ‘ভবিষ্যত বিষয় সম্পর্কেও তোমাদেররকে অবহিত করবে।’ ১৪০০ বছর আগে নাযিল হওয়া পবিত্র কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণীর রহস্য এখনও অনাবৃত রয়েছে এবং শেষ বিচারের দিনে তার সত্যতা পুনরায় প্রমাণিত হবে যখন আল্লাহ তাআলা সকলের সামনে প্রকাশ করবেন যে, মূসা ও ঈসা যথার্থই বলেছিলেন এবং শেষ নবীর অস্বীকারকারীরা চরম দণ্ড ভোগ করবে। খোদা সম্পর্কে পুরাতন টেস্টামেন্টে আরেকটি বক্তব্য আছে এভাবে : ‘এবং এমনও ঘটবে যে, যারা আমার কথা কেনোদিন শোনেনি তিনি (শেষ নবী) সে কথা আমার নামে তাদেরকে বলবেন, তাঁর কাছে এটাই আমার চাওয়া (আমি তাঁকে তার বদলা দেব)’। (Deuteronomy, 18 : 19)

আর কত সুস্পষ্টভাবেই না পবিত্র কুরআন ‘সে আমার নামে বলবে’ এ কথা তুলে ধরেছে। অন্য যে কোনো গ্রন্থের তুলনায় পবিত্র কুরআন তার ১১৪টি সূরার সমস্ত বক্তব্যের শুরুতেই ‘দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে’ এ কথা সংযোজন করে একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের স্বাক্ষর রেখেছে।

আল্লাহ তাআলা কখনই তাঁর অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হন না। এ কথা নিশ্চিত যে, যারা শেষ নবীর বাণীকে অস্বীকার করবে মূসা (আ.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক তাদের ওপর শাস্তি আপতিত হবে এবং সে শাস্তি হবে: ‘কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফ্‌রি করে তারা এবং মুশরিকরা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে, তারাই সৃষ্টির অধম।’ (সূরা বাইয়্যিনাহ : ৬)