শনিবার, ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২রা ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইসলামী ঐক্যের মূর্তপ্রতীক ইমাম হাসান আল-আসকারী (আ.)

পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৬ 

news-image

‘এবং তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না…’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)

ইসলামী ঐক্যের অত্যুজ্জ্বল আদর্শ ইমাম হাসান ইবনে আলী আল আসকারী (আ.) ৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ২৩২ হিজরির ৯ রবিউস সানী মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। সে সময় ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। আব্বাসী শাসকদের অত্যাচার-উৎপীড়ন তখন চরমে উঠেছিল। গোটা মুসলিম জাহানে বিশৃঙ্খলা, মতবিরোধ ও ধর্মীয় মতভেদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। উমাইয়্যাদের মতো আব্বাসীরাও জোর-যুলুমের রাজত্ব কায়েম করে। ধর্মহীনতার চর্চা করে তারা মুসলিম উম্মাহকে ‘আল্লাহর রজ্জু’ থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস পায়।

কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ জনগণকে পথপদর্শক ছাড়া রাখেন না। সেই সময়ে মুসলিম উম্মাহর মহান পথপ্রদর্শক ছিলেন ইমাম হাসান আসকারী (আ.)। শত অত্যাচার-উৎপীড়নের মুখেও মহানবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইত অন্ধকারে আলোর দিশারীর মতো মুসলমানদেরকে পথনির্দেশনা দিতেন এবং মহানবী (সা.) ও তাঁর বংশের অনুসরণীয় আদর্শ জনগণের মাঝে তুলে ধরতেন। এ কারণে স্বৈরাচারী শাসকরা রাগান্বিত হয়ে আহলে বাইতের ওপর অনেক অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়, ইমামদেরকে বন্দি করে রাখে। শত অত্যাচার সত্ত্বেও মহান ইমামগণ সত্যের বাণী তুলে ধরতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেননি।

ইমাম হাসান আল আসকারী ছিলেন একাদশ ইমাম। তাঁর মহান পিতা ইমাম আলী আল হাদী ছিলেন দশম ইমাম। তখন শাসন ক্ষমতায় ছিলেন আব্বাসী খলিফা মুতাওয়াক্কিল। আহলে বাইতের প্রতি জনসাধারণের ক্রমবর্ধমান সম্মান ও সহানুভূতি লক্ষ্য করে খলিফা মুতাওয়াক্কিল ভয় পেয়ে যান। আহলে বাইতের জনপ্রিয়তাকে দমন করার জন্য তিনি ইমাম আল হাদী (আ.)-কে বন্দি করেন এবং সামাররায় নিয়ে আসেন। এটা ৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। তখন ইমাম আল হাসান আসকারী (আ.) মাত্র তিন বছরের শিশু। জনসাধারণের কাছ থেকে আহলে বাইত তথা ‘আল্লাহর রজ্জু’কে বিচ্ছিন্ন করে রাখার হীন উদ্দেশ্যে খলিফা মুতাওয়াক্কিল ইমাম পরিবারকে সামরিক শিবিরের একটি বদ্ধ ঘরে আটকে রাখে। এ ঘরে একাদশ ইমাম তাঁর পিতার সাথে বন্দি ছিলেন বলে তাঁকে ইমাম আসকারী বলা হয়। ‘আসকারী’ অর্থ সামরিক।

মহানবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র বংশধরদের প্রতি খলিফা মুতাওয়াক্কিলের শত্রুতা ছিল সর্বজনবিদিত। এ খলিফাই একবার তার ছেলেদের গৃহ শিক্ষককে হত্যা করেন। খলিফার দুই ছেলে মু’তাজ এবং মুয়াইয়াদের গৃহশিক্ষক ছিলেন ইবনে সুকাইত। বর্ণিত আছে যে, একবার খলিফা মুতাওয়াক্কিল শিক্ষক ইবনে সুকাইতকে জিজ্ঞেস করেন যে, তার দুই ছেলে আর মহানবী (সা.)-এর দুই নাতি হাসান ও হোসাইনের মধ্যে কোন দু’জন অধিক সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। শিক্ষক আন্তরিকতার সাথেই জবাব দেন যে, মহানবীর দুই নাতি তো উঁচু স্তরের। এমনকি হযরত আলীর খাদেম কাম্বারও মুতাওয়াক্কিলের দুই ছেলের চেয়ে উত্তম। এ কথা শুনে রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যান খলিফা। সাথে সাথে হুকুম করেন শিক্ষক ইবনে সুকাইতের জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলার জন্য। তৎক্ষণাৎ সেই আদেশ পালন করা হয়। এভাবে মৃত্যুবরণ করেন ইবনে সুকাইত। তাঁর দোষ ছিল তিনি খলিফার পুত্রদের চেয়ে মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যদের প্রাধান্য দিয়েছিলেন। শুধু এ অপরাধেই তাঁকে হত্যা করা হয়।

২২ বছর বয়সে হাসান আল-আসকারী (আ.) ইমামত প্রাপ্ত হন। তাঁর মহান পিতা ইমাম আল হাদী (আ.)-এর শাহাদাতের পরেই তিনি এই সম্মান লাভ করেন। আব্বাসী খলিফা মু’তাজ ২৪৭ হিজরিতে ইমাম আল-হাদীকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন।

দশম ইমামকে হত্যা করার পরও আব্বাসী শাসকদের ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি। আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্যের প্রতি তারা কড়া নজর রাখে। বিশেষ করে ইমাম আল-হাদীর সুযোগ্য উত্তরসূরি ইমাম আল-আসকারীর কর্মকাণ্ডের ওপর গোয়ান্দাবৃত্তি অব্যাহত থাকে। লোকজনের কাছে যাতে ইমামদের বাণী পৌঁছতে না পারে, জনসাধারণ যাতে ইসলামের প্রকৃত আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বাধীন হতে না পারে সে জন্য আহলে বাইতের কাজকর্মে নানাভাবে বাধা প্রদান করা হতো, তা সত্ত্বেও ইমাম হাসান আল-আসকারী অত্যাচারী-যালেমদের সামনে মাথা নত করেননি। তিনি বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাঝেও তাঁর ইসলাম প্রচার মিশন অব্যাহত রাখেন। জনগণের মাঝে আল-কুরআনের শিক্ষা এবং মহানবী ও তাঁর আহলে বাইতের আদর্শ প্রচার করতে থাকেন। তিনি তাঁর অনুসারীদের ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী করে তোলেন এবং পরবর্তী ইমামের অবর্তমানে কিভাবে ইসলামের মিশন অব্যাহত রাখতে হবে সে ব্যাপারে তাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। কারণ, তাঁর পুত্র ইমাম মাহদী (আ.) হবেন শেষ যামানার ইমাম। তিনি গায়েব থাকবেন (আহলে বাইতের মাযহাব অনুযায়ী)। পরে কেয়ামতের আগে আত্মপ্রকাশ করে গোটা পৃথিবীতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। আব্বাসী শাসকদের অত্যাচার থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ইমাম মাহদী (আ.)-এর শুভ জন্মের খবর গোপন রাখা হয়। ইমাম আসকারীর কিছু ঘনিষ্ঠ সহচরই তাঁর জন্মের খবর অবগত হন।

আব্বাসী শাসকরা ইমাম হাসান আসকারীর কর্মকাণ্ডে নানাভাবে বাধা দিতে থাকে, নানাভাবে তাঁকে নাজেহাল করে। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ‘আল্লাহর রজ্জু’কে কেটে ফেলা যাতে মুসলমানরা সেটার ওপর ভিত্তি করে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে। কারণ, মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হলে তাদের শোষণ, নিপীড়ন ও তাগুতী শাসনের অবসান ঘটবে। এভাবে ষড়যন্ত্র করতে করতে ২৬০ হিজরির ৮ রবিউল আউয়াল আব্বাসী শাসকরা ইমাম হাসান আল-আসকারীকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে। কিন্তু চেষ্টা করেও আব্বাসীরা আল্লাহর রজ্জুকে কেটে ফেলতে পারেনি; বরং নিজেদের দুনার্মের বোঝা আরো বাড়িয়েছিল মাত্র। আল্লাহর রজ্জুর দ্বাদশতম গিঁট তারা খুলতে পারেনি। আহলে বাইতই যে আল-কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর সেই রজ্জু তার কিছু প্রমাণ উল্লেখ করা হলো। আবু ইসহাক ছা’লাবী তাঁর কুরআনের তাফসীরে, আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী তাঁর ‘সাওয়ায়িক আল-মুহরিকা’য় স্বীকার করেছেন যে, উপরিউক্ত ‘আল্লাহর রজ্জু’ বলতে মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতকেই বুঝানো হয়েছে।

সুন্নি মাযহাবের প্রখ্যাত ইমাম হযরত ইমাম শাফেয়ী (রহ.) কাব্যে চমৎকারভাবে ‘আল্লাহর রজ্জু’ এভাবে বর্ণনা করেছেন :

যখন দেখি জনগণ ফিরিয়েছে মুখ-

অজ্ঞতা আর ভ্রান্তির অতলে নিমজ্জিত হয়ে

আল্লাহর নামে করেছি আরোহণ নাজাতের তরণীতে,

যার নাম আল মোস্তফার আহলে বাইত।

এবং আমি ধারণ করেছি আল্লাহর রজ্জু

আহলে বাইতের ভালোবাসার জন্য,

কারণ, মহাপ্রভুর আদেশ ‘ধারণ কর তা সুদৃঢ় বন্ধনে।’