ইরানে পর্যটকদের জন্য ৩৪টি অসাধারণ স্থাপত্য নিদর্শন
পোস্ট হয়েছে: এপ্রিল ১০, ২০১৭
রাশিদ রিয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী মিডিয়া সিএনএন’ এর সিনিয়র প্রডিউসার ব্যারি নিল্ড ইরানের পর্যটন সম্পর্কে তার প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছেন, ‘থার্টি ফোর ইনক্রেডিবল বিউটিফুল রিজন্স টু ভিজিট ইরান’। বলার অপেক্ষা রাখে না, সাত সভ্যতা ও সংস্কৃতির মিশ্রণ যে দেশে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে সে দেশের ৩৪টি দর্শনীয় স্থানের ছবি তিনি সিএনএন অনলাইনে দিয়েছেন।
ব্যারি নিল্ড তার প্রতিবেদনে বলছেন, দৃষ্টি আকর্ষণীয় বিষয় হলো এসময়ে ইরান নিয়ে সবাই কথা বলছেন। যে যাই বলুক ইরান সবসময় ভ্রমণপিয়াসুর জন্যে অন্যান্য এক আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে কেন বিবেচনা হয় তা এ প্রতিবেদনে বর্ণিত স্থানগুলো সম্পর্কে আপনার জানা হলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ইরানের অসাধারণ এসব স্থানগুলোর ছবি ক্যামেরায় বন্দি করেছেন দেশটির প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক মোহাম্মদ রেজা ডোমিরি গাঞ্জি। তিনি ইরানের বিখ্যাত মসজিদগুলোর ছবি তুলে ইতিমধ্যে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ইরানের এসব দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে আরো জানতে ও ছবি দেখতে গাঞ্জিকে অনুরোধ করেন ব্যারি নিল্ড। সাড়া দেন গাঞ্জি।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ৩৮তম বার্ষিকী পালিত হল। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব হওয়ার পর পশ্চিমা বিশ্ব দেশটির ওপর অবরোধ জারি করে রাখে। ইরান সম্পর্কে আলোড়ন মিশানো আবেগ আমাদের মনে থাকার পাশাপাশি একটি বিষয় সুনিশ্চিত আর তা হচ্ছে দেশটির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি আর সৌন্দর্য যা উদযাটিত হয়ে আসছে।
ইসফাহানের আলী কাপু
ইরানের পশ্চিমাঞ্চল ইসফাহানে নাকশ-ই-জাহান স্কয়ার, যেখানে ৬ তলা প্রাসাদ রয়েছে আর এর নামের অর্থ বলা যায় সিংহদুয়ার। ষোল থেকে সপ্তদশ শতকে শাহ আব্বাসের আমলে এ প্রাসাদ নির্মিত হয়। প্রাসাদে লাল রংয়ের মিউজিক হল রয়েছে যা নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে বিকশিত। প্রাসাদের প্রাচীর সজ্জা দেখার মত। দারুণ এক প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে এ প্রাসাদের আবহ।
অনন্য ও গৌরবময় ও বিশেষ ধরনের স্থাপত্যরীতি দেখে গাঞ্জি বিস্ময় বোধ করেন এবং তা ক্যামেরায় ধারণ করতে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। গাঞ্জি বলেন প্রাসাদের মিউজিক হলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মাথার ওপর ক্যামেরা তাক করে আমি ছবি তুলতে থাকি এবং ওয়াইড-এ্যাঙ্গেল লেন্স ব্যবহার করি।
সিরাজের আর্গ-ই কারিম খান
আঠারো শতকে নির্মিত কারিম খানের দুর্গ ঐতিহ্যবাহী শহর সিরাযের কেন্দ্রে অবস্থিত। দুর্গের ভেতরে আবাসিক ভবন অবস্থিত, রয়েছে হাম্মামখানা বা গোসলখানা। দুর্গের চত্বর লেবু গাছে ভরা। বাতাসে পাকা রঙ্গিন লেবুগুলো যখন গাছে দোল খায় তখন তা ভ্রমণকারীদের মনে শিহরণ জাগায়। পারস্যরীতিতে নির্মিত ছিদ্রময় দেয়াল দুর্গের চারপাশে বেষ্টনী তৈরি করে রেখেছে। ওই ছিদ্র দিয়ে শত্রুর আগমন বা কারো অবস্থান সহজেই চিহ্নিত করা যায়। দেয়ালে সুন্দর চিত্রকলা শোভা পাচ্ছে। ক্ষুদ্র চিত্র রয়েছে তাতে।
গাঞ্জি বলেন, অনন্য স্থাপত্য, আলো ও ঐতিহ্যের নিদর্শন হাম্মামখানার মধ্যে প্রবেশ করলেই যে কারো নজর কাড়বে।
তেহরানের বোর্য-ই আযাদি
১৯৭১ সালে নির্মিত এ আযাদি টাওয়ারটি ইরানের রাজধানী তেহরান শহরের একটি প্রতীক হয়ে ওঠে। ২০০৯ সালে তেহরান শহরে মিলাদ টাওয়ার নির্মিত হয়। ৩৬০ মিলিয়ন ডলার খরচে এ টাওয়ারটি নির্মিত হলেও আযাদি টাওয়ারটি তেহরানের বাসিন্দা ও পর্যটকদের আলাদা এক আকর্ষণে টানে। আজাদি টাওয়ারটি নির্মাণ করেন প্রখ্যাত স্থপতি হোসেন আমানত। পারস্য সাম্রাজ্যের আড়াই হাজার বছরের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আজাদি টাওয়ার নির্মিত হয়।
গাঞ্জি বলেন, আযাদি টাওয়ারের অনন্য স্থাপত্যরীতির জন্যে এ নির্মাণ শিল্পকে খুব পছন্দ করি। এছাড়া কোনো বিষয়কে প্রতীকি হিসেবে উপস্থাপন করতে চাই আমি। ছবি তোলার এক মাহাত্ম্যকে আমি ধারণ করতে আযাদি টাওয়ার হয়ে ওঠে আমার কাছে এক নিদর্শন। এধরনের নজির সৃষ্টিতে আমি ক্যামেরার ফিশআই বা বিশেষ ধরনের লেন্স ব্যবহার করি। আযাদি টাওয়ারের মাথায় মেঘমালা আমাকে এধরনের অনন্য ছবি তুলতে সাহায্য করে।
মাযানদারানের বাদাব-ই সুরাত
ইরানের মাযানদারান প্রদেশে প্রাকৃতিক নিসর্গের লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত বাদাব-ই সুরাত দীর্ঘকাল থেকে পর্যটকদের নজর কাড়ছে। হাজার হাজার বছর ধরে প্রাকৃতিক এ সৌন্দর্য বিশ্বের পর্যটকদের কাছে টেনেছে। ইরানের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এ উষ্ণ প্রস্রবণ লবণাক্ত ও সালফার সমৃদ্ধ। পানিতে আকাশের প্রতিচ্ছবি ও চারপাশের নিসর্গময় প্রান্তর এর সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানান গাঞ্জি।
কাশানের বোরোজার্দি হাউস
১৯ শতকে কার্পেট ব্যবসায়ীদের বাড়িগুলো কাশানে এখন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। বাড়িগুলোর নান্দনিক সৌকর্য রয়েছে কারণ ১৯ শতকের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী কামাল-ওল-মোলকের অলঙ্কার শোভিত কারুকাজ শোভা পাচ্ছে এ নির্মাণ শিল্পে। ইরানের কার্পেট শিল্প খুবই প্রাচীন এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক শিল্প। এখনো তেলের পরই কার্পেট দ্বিতীয় রফতানি আয়ের স্থান দখল করে রেখেছে। বাড়িগুলোর মেঝের ডিজাইন বিশ্বে সুপরিচিত হয়ে আছে। সিরাযের একটি কার্পেট মেরামত কেন্দ্রের ছবি তোলেন গাঞ্জি। তিনি বলেন, জীবনযাত্রার যে এক মাধুর্য রয়েছে তা এই কার্পেট মেরামত কেন্দ্রে কর্মীরা জানান দিচ্ছে। একটি কার্পেট মেরামতের মধ্যে দিয়েও কর্মীরা তার নান্দনিক মান ফুটিয়ে তোলেন।
ইয়াযদের বাগ-ই দৌলত আবাদ
১৮ শতকের দৌলত আবাদ বাগান আধুনিক ইরানের নকশা ধারণ করে আছে। বাগানটি দুই ভাগে বিভক্ত। বাগানের বহির্ভাগ নানা ধরনের ফুলে শোভিত হয়ে আছে। যা বাগানে ঢুকতেই চোখে পড়ে। বাগানের ভেতরে প্রবেশ করতে পারলে আপনি টের পাবেন ইরানি পারিবারিক গোপনীয়তার এক স্থাপত্যময় ধারণা। মরু এলাকায় এসব বাগ-বাগীচা ও তার আশে পাশের ভবনগুলোতে সহজেই বাতাস প্রবেশ করতে পারে। রয়েছে ছাদের ওপর টাওয়ার। একই সঙ্গে এমন এক ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা যাতে প্রাকৃতিকভাবেই বাতাস এর মাধ্যমে প্রবেশ করে ভবনের ভেতরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখে। ভবনে রঙ্গিন কাঁচের ব্যবহার ও তাতে আলোর খেলা নানা ধরনের বর্ণময় এক আবেগ সৃষ্টি করে। এক ভিন্ন সৌন্দর্যের আবহ সৃষ্টি করে। গাঞ্জি বলেন, প্রাসাদে বাতাসের খেলা আমার মনোযোগ কেড়ে নেয়। বাতাস এসে প্রাসাদের মাঝখানে একটি ছোট জলাশয়ে আবর্তিত হয় এবং বাষ্পীভূত হয়ে তা ফের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং গরম হাওয়া ঠাণ্ডা করে। পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখার এমন প্রাকৃতিক পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক যুগের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
তেহরানের ইমারত-ই বাদগির
তেহরানে ১৯ শতকে নির্মিত গোলেস্তান প্যালেসে এই ইমারতটি নির্মিত হয়। কাজার রাজবংশের মোজাফফর-আদ-দীন শাহর রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে এ ইমারত গড়ে তোলা হয়। গাঞ্জি বলেন, ইমারতের অলঙ্করণ, বিশেষ করে রঙিন কাচের ব্যবহার, আয়না ও সুউচ্চ স্তম্ভ ইমারতটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে আছে।
সিরাজের এরাম গার্ডেন
ইরানের ঐতিহাসিক বাগানের একটি। ১৩ শতকের মাঝামাঝি এ বাগান ও ভবন নির্মাণ হওয়ার ৬শ’ বছর পর সংস্কার করা হয়। বিশাল এক বোটানিক্যাল গার্ডেনই শুধু নয়, নানা ধরনের দুস্প্রাপ্য গাছগাছালি এরাম গার্ডেনের গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে। গাঞ্জি বলেন, বাগানে হাঁটার সময় চারপাশের সবুজ গাছপালা ও নানা রংয়ের ফুল শোভা বর্ধন করে আমাকে সুস্থ শক্তি যোগায়। এসব গাছগাছালি শুধু গাছ নয়, রয়েছে এর ওষধি ও ভেষজ মূল্য। বাগানের সঙ্গে নান্দনিক স্থাপত্য সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাগানের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা লেক প্রাকৃতিকভাবেই পানির যোগান দিয়ে চলেছে। লেকের বুকে বিশাল ভবনের প্রতিফলিত ছবি মুগ্ধ করে। সূর্য অস্ত যাবার সময় আকাশের গোধুলি ও রংয়ের পরিবর্তন ছবি তোলায় নানা বৈচিত্রময় পরিবেশ হয়ে ধরা দেয়।
সিরাজের ফরোঘ-আল-মুলক হাউজ
কাজার শাসনামলে নির্মিত এ তিনতলা ভবনটি বর্তমানে যাদুঘর। বিখ্যাত কবি হাফেয সিরাজীর মাযার এখানে। অনেকে আসেন কবির মাজার জেয়ারত করে যান। নিজের লেখা কবিতা গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে যান। কেউ বসে চা খান। বিভিন্ন হাতের লেখা প্রচুর কবিতা পড়তে পেরে আপনি বিস্ময় বোধ করবেন।
ইয়াযদের জামে মসজিদ
১৫ থেকে ১৬ শতাব্দীতে নির্মিত এ মসজিদ তিমুরিদ শাসনামলের তা বোঝা যায় শিলালিপি ও স্থাপত্য রীতি দেখে। তবে মূল ভবনটি এক শতাব্দীর পুরোনো। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন প্রাচীন অগ্নি মন্দিরের ওপর এ মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। গাঞ্জি বলেন, যখন তিনি মসজিদটিতে প্রবেশ করেন, তখন বিস্ময় বোধ করেন, ছাদে অপরুপ স্থাপত্য শৈলী দেখে। সহজেই পর্যটকদের নজর কাড়ে। মসজিদের গম্বুজ আরব স্থাপত্য রীতি মেনে নির্মিত এবং এর চত্বরও জ্যামিতিক আকারে বেশ প্রশস্ত। গম্বুজের গায়ে কোরানের আয়াত লিপিবদ্ধ রয়েছে যা ঐতিহ্য আর সৌন্দর্যের মিশেল বহন করছে।
কোরদাস্ত বাথ, জুলফা
ইরানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চল শহর জুলফায় এ গোসলখানা শাসক ও রাজকীয় কর্মকর্তা কর্মচারীরা এক সময় ব্যবহার করতেন। পরে সাধারণ মানুষের মধ্যে এর ব্যবহার দেখা যায়। ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ, চাঁদনি ও বাসন্তি মন্দির ও গ্রিনহাউজ রয়েছে এখানে। ১৬ থেকে ১৮ শতকে সাফাবি আমলের নিদর্শন হয়ে আছে এ গোসলখানা।
কাশানের কাছে মারানযাব সল্ট লেক
তেহরানের দক্ষিণে মারানযাব মরুভূমিতে এ লবণাক্ত লেকটি অবস্থিত। এটি আসলে শুকিয়ে যাওয়া এক হ্রদ। প্রবল বর্ষণ ও বরফপাতের পর অনেকে এখান থেকে পানি সংগ্রহ করেন। লেকের বুকে রাতের বেলা হেঁটে হেঁটে ছবি তোলার দারুণ এক অনুভূতির কথা বলেন গাঞ্জি।
মারানযাবের বালুর সৈকতে হেঁটে বেড়ানোর এক মধুর স্মৃতি অনেকের আছে। আবার বরফপাতের সময় আরেক দৃশ্যের অবতারণা হয়। ইরানের এক প্রান্তে শীতে বরফপাত আবার অন্যপ্রান্তে ধুসর মরুভূমিময় দিগন্তের হাতছানি আপনাকে এক অদ্ভুত মায়ার বাঁধনে জড়াবে। বরফে জড়ানো পথে ঘন্টার পর ঘন্টা মটরড্রাইভ তার পর মরভূমির পথে হারিয়ে যেতে কারা না ভাললাগে। সেখানে সূর্যদয়ের ছবি তুলতে সবাই যেন উন্মুখ হয়ে থাকে।
সিরাজের নাসির আল-মুলক মসজিদ
কাজার আমলের আরেক সেরা স্থাপত্য নিদর্শন নাসির আল-মুলক মসজিদ। এই মসজিদের পূর্ব ও পশ্চিমে শয়নগৃহ রয়েছে। রয়েছে টালির সুদৃশ্য মেঝে, ১২টি স্তম্ভ আর রঙিন জানালা। রঙিন কাচের জানালা দিয়ে সূর্যকিরণ যখন মসজিদের মেঝেতে প্রবেশ করে তখন সারা মসজিদের চত্বর জুড়ে আলোর এক দুর্দান্ত খেলা খেলতে থাকে। রঙিন কাচের খেলা অনেক ভবন জুড়েই দেখা যায় তবে এ মসজিদের দৃশ্যই আলাদা। আসলে এ মসজিদটি পরিপূর্ণ আলোর নাচনে ও খেলায় ভরপুর। তারপর ইরানি রঙ্গিন কার্পেট আর ছাদের কারুকাজময় সৌকর্য, টাইলসের প্যাটার্ন ও রঙ আপনাকে বিমোহিত করবেই।
গাঞ্জি বলেন, আমি এ মসজিদের স্থাপত্যরীতি দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। শীতের সকালে আলোর অপেক্ষায় এ মসজিদে বসে থেকেছে। আস্তে আস্তে আলো এসেছে, তার পর রঙ্গিন কাঁচ ভেদ করে মসজিদের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে। আলোর নাচন শুরু হয়ে যায় তখন।
তেহরানের নিয়াভারান প্রাসাদ
ইরানে ইসলামি বিপ্লবের আগে এ নিয়াভারান প্রাসাদ রেজা শাহ পাহলভির পরিবার বাস করতেন। এ প্রাসাদে বিদেশি অতিথিরা রেজা শাহ পাহলভির সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। প্রাসাদটি আসলে নির্মিত হয়েছিল কাজার শাসনামলে। মূলভবনটি নির্মাণ হয় ইরানের শেষ শাহ রেজা শাহের আমলেই।
সিরাজের দক্ষিণে আরদাসির প্রাসাদ
তৃতীয় শতাব্দীতে পারস্যের শাসক আরদাসির যিনি সাসানীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করছিলেন, তিনি এই প্রাসাদ তার নিজের জন্যে তৈরি করিয়েছিলেন। প্রাসাদের বাইরে একটি হ্রদ থেকে পানি সরবরাহ করা হত। তবে ওই হ্রদটি শুকিয়ে যাওয়ার পর প্রাসাদটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
উত্তরপূর্ব সিরাজের পাসারগাদ
পাসারগাজাই হচ্ছে হাখামানেশী সাম্রাজ্যের আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পাঁচশ পঞ্চাশ সালে নির্মিত এক কমপ্লেক্স ভবন। সিরায শহর থেকে ১৩০ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে এটি অবস্থিত। সাইরাস আমলের বিখ্যাত ভবন সলোমনের সময় কারাগার ও পরবর্তীতে দুর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পারস্যের অনেক শাসকের কাছেও এ ভবনের গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। রাতে এ প্রাসাদে অবস্থান করে তারাভর্তি আকাশ দেখতে পেয়ে অন্য এক আনন্দ ভুবনে চলে যাবেন। আকাশ পরিস্কার থাকলে গ্রীস্মকালে এ প্রাসাদ থেকে আপনি সৌর জগতের এক ধারণা উপলব্ধি করতে পারবেন। মিল্কি ওয়ে বা আকাশপথ দেখতে পাবেন।
এই পাসারগাদে সাইরাসের রাজকীয় প্রাসাদ আরেক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। পারস্য সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ বাগবাগীচায় ভরা প্রাসাদের চারপাশ আপনাকে ভিন্ন জগতে নিয়ে যাবে। দর্শকদের জন্যে প্রাসাদে এক বিশাল হলরুম রয়েছে । রয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। গাঞ্জি বলেন, ছবি তোলার এক পর্যায়ে আমি মুগ্ধ হয়ে ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলাম আকাশের দিকে তাকিয়ে। ভাবছিলাম, হাজার বছর আগে এখানেই সাইরাস স¤্রাট তার পরিষদ নিয়ে বসতেন, পুরো পারস্য সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন। সমাধি সৌধ থেকে আনত ঢালু ছাদ পাথরের সাতটি স্তরে নির্মিত। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৬ অব্দে আলেক্সান্ডার গ্রেট যখন পারস্য দখল করেন তখন তিনি পাসারগাদ ধ্বংস করেন। রাজকোষ লুট করেন। এমনকি প্রাসাদের অনেক ভগ্নাংশ তার সৈন্যরা নিয়ে যায়।
সিরাযের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পারসেপলিস (তাখতে-ই-জামশিদ)
পারসেপলিস হচ্ছে পারস্য সাম্রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। এ ঐতিহাসিক শহরটিও আলেক্সান্ডার গ্রেটের হাতে ধংস হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে। পারসেপলিস হচ্ছে সেই স্মৃতিময় ও ঐতিহাসিক স্থান যেখানে অনেক সম্্রাটের পদধুলি পড়েছে, নানা সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে, সভ্যতা আবর্তিত হয়ে উঠেছে। বলা যায় সকল জাতির দ্বার উন্মোচন হয়েছে পারসেপলিসে এসে। অতীতের সঙ্গে এক অবিশ্বাস্য সেতু বন্ধন এই পারসেপলিস। পাসারগাজির মত পারসেপলিসেও রাতে ছবি তুলতে চাইলে অনুমতির প্রয়োজন হয়। এবং এ অনুমতি পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
ইসফাহানের ইমাম মসজিদ
ইসফাহান শহরের দক্ষিণাঞ্চলে নাখশ-ই-জাহান স্কয়ারে অবস্থিত এ মসজিদ সাফাভি আমলে নির্মিত। প্রথম শাহ আব্বাসের নির্দেশে এ মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদটিতে গম্বুজগুলো ১৭০ ফুট উঁচু। গাঞ্জি বলেন, এ মসজিদের ছাদে যে কারুকাজ যা অন্য কোনো স্থানের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। এক অসাধারণ সৌকর্যের স্থাপত্যরীতি ও শৈলীর ছাপ এখানে দেখা যায়। মসজিদের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাঞ্জি ওয়াইড লেন্স ব্যবহার করে তার ক্যামেরায় ছবি তোলেন। যাতে সঠিক প্রতিচ্ছবি ছবিতে উঠে আসে।
ইসফাহানের রয়াল মসজিদ
ইসফাহানের শেখ লোতফোল্লাহ মসজিদ আরেক বিস্ময়। এটিও প্রথম শাহ আব্বাস শাসনামলে নির্মিত। এ মসজিদের মোজাইক বিখ্যাত স্থপতি শেখ বাহাইয়ের নির্দেশনা অনুসারে বিন্যস্ত করা হয়েছে নির্মাণকালে। শেখ বাহাই তার সময়ে সেরা একজন ক্যালিগ্রাফার ও শিল্পী হিসেবে খ্যাত ছিলেন। মসজিদটি মক্কার দিকে পশ্চিমমুখী হয়ে ৪৫ ডিগ্রি কোণে নির্মিত। এ মসজিদটি ইরানে একমাত্র মসজিদ যাতে কোনো উন্মুক্ত চত্বর নেই।
শেখ শাফি আল-দিন খানকাহ এবং মাযার, আরদাবিল
এ হচ্ছে সাফাভি সাম্রাজ্যের আরেক নিদর্শন। এটি এজন্যে বিখ্যাত যে শাহ ইসমাইলের পূর্ব পুরুষ শেখ শাফি আল-দিনএর মাজার রয়েছে। পোরসিলেনের স্তম্ভ আর উদ্যানে আচ্ছাদানযুক্ত বিশ্রাম স্থান আপনাকে মুগ্ধ করবে। এখানে আপনি চীনা শাসকদের দেয়া উপহার হিসেবে অনেক বয়াম দেখতে পাবেন।
ইসফাহানের ৩৩ পোলের সেতু যা পরিচিত আল্লাহভারদি খান সেতু হিসেবে। প্রথম শাহ আব্বাসের আমলে এ সেতুটি নির্মিত হয়। পানিতে সেতুটির খিলানপথ সম্প্রসারিত। এ স্থানটি পায়চারি বা ঘুরে বেড়ানোর জন্যে বেশ জনপ্রিয়।
কাশানের সুলতান আমির আহমেদ হাম্মামখানা
১১ শতাব্দীর সেলজুক আমল ও কাজার আমলের মিশ্রিত স্থাপত্যরীতিতে সুলতান আমির আহমেদের গোসলখানা তৈরি হয়েছিল। যে চুনের পলেস্তার আপনি এখানে দেখতে পাবেন তা সেই আমলে হামান দিস্তা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। রয়েছে অলঙ্কারময় কারুকাজ হাম্মামখানার দেওয়ালে। যা দেখে অভিভূত হবেন আপনি। গাঞ্জি বলেন, ছবি তোলার ফাঁকে ফাঁকে আমি অনেকবার এ হাম্মামখানার বিভিন্ন স্থানে বসেছি। কিন্তু কখন যে ঘন্টা পার হয়ে যেত বুঝতাম না। তারপরও অপেক্ষা করতাম কখন কৃত্রিম আলো নিভে যাবে। এবং ছাদের গর্ত দিয়ে অকৃত্রিম আলোর খেলা নাচন দিতে শুরু করবে। মজার কথা হচ্ছে হাম্মামখানার পানির নিচে তাপমাত্রার উৎস থেকে ধোঁয়ার কু-লী পাক খেয়ে আসা বা ছোট শিখার দুলুনি দেখতে পাওয়া যেন এক রহস্যের উদ্ঘাটন।
মাকুতে সন্ন্যাসী থাদিয়েসের মঠ
এ মঠটি ইরানে কালো মঠ হিসেবে পরিচিত কারণ কালো পাথর ব্যবহার করা হয়েছে মঠটি নির্মাণে। ইরানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে এ স্মৃতিস্তম্ভ খ্রিস্টান অঞ্চলের প্রথম বছরগুলোর স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। বিশেষ করে আর্মেনিয়রা তীর্থযাত্রী হিসেবে আসেন এ মঠ পরিদর্শনে। ইরানের অমুসলিম নাগরিকদের কাছে এ মঠ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। গাঞ্জি বলেন, কঠিন শীতের রাতে একবার ছবি তোলার সুযোগ বা অনুমতি পেয়েছিলাম এই মঠে। একমাত্র ছোট গার্ডরুম ছাড়া মঠের আর কোথাও তখন কোনো বাতি জ্বালানো ছিল না।
কাশানের তাবাতাবায়ি হাউজ
কাজার সাম্রাজ্যের এক বিখ্যাত কাশান ব্যবসায়ী এ হাউজটি নির্মাণ করেন। ভবনের বিভিন্ন ধাপে ভিন্ন ভিন্ন কারুকাজ রয়েছে, রয়েছে চিত্রকর্ম এবং কাচের বাহারি ব্যবহার যা এক অসাধারণ স্থাপত্য বৈশিষ্ট সৃষ্টি করে আছে।
কাশানের তিমচেহ
এ এক ছোট পান্থনিবাস। কাশান বাজারের কাছে যা অবস্থিত। ছোট ছোট ছাদে নির্মিত এ পান্থনিবাসগুলো ইরানের বিখ্যাত হাতে তৈরি কার্পেট বিক্রির জন্যে ব্যবহৃত হত। কাজার সাম্রাজ্যের সময় শুধু কার্পেট নয়, বিলাসবহুল পণ্য বিক্রির জন্যে ব্যবহৃত হত পান্থনিবাসগুলো। গাঞ্জি বলেন, এসব পান্থনিবাসের ছাদের কারুকাজ দেখার মত। চারপাশে দৃষ্টিনন্দন কার্পেটের ছড়াছড়ি, ঐতিহাসিক মূল্যবান সব পণ্য সাজানো আর ছাদের নিচেই বড় পুকুর।
সিরাজে মহাকবি হাফেজের সৌধ
১৪ শতাব্দীতে নির্মিত ইরানের বিখ্যাত কবি হাফেজের সৌধ রয়েছে সিরাযে। দীর্ঘ ইতিহাসে এ সৌধ বহুবার সংস্কার করা হয়েছে। সর্বশেষ সংস্কারটি হয়েছে ফ্রান্সের বিখ্যাত স্থপতি আন্দ্রে গোদার্দ ও ইরানের প্রতœতত্ত্ববিদ আলি সামির দিক নির্দেশনায়। গাঞ্জি বলেন, হাফেজের সমাধি প্রান্তর সবসময় তার ভক্তদের ভিড়ে পরিপূর্ণ থাকে। বিকেল ও সন্ধ্যায় কবি ও কাব্যপ্রেমীদের ভিড়ে, দল বেঁধে বন্ধু, তরুণ দম্পতি যারা এখানে আসে তাদের অনেককেই দেখা যায় কবি হাফেজের রোমান্টিক কবিতা আবৃত্তি করতে। গাঞ্জি বলেন, এসব দৃশ্য ধরে রাখতে ক্যামেরার ফিশআই লেন্স ব্যবহার করি দিনের বেলায়। একদিন ইরানের দুই জনপ্রিয় ফুটবল দলের খেলা ছিল আর সেদিন সেই খেলা দেখতে অনেকেই ব্যস্ত ছিল বলে কবি হাফেজের সৌধ এলাকা কিছুটা ফাঁকা পেয়েছিলাম।
বিস্ময়কর স্থাপত্যসৌধ : ভাকিল বাথ
১৮ শতাব্দীর জাদ রাজবংশের সময়ে ভাকিল বাথ স্থাপত্যসৌধ তৈরি হয়। এ সৌধে সমাধিক্ষেত্রে পারস্যের পুরানকালের চিত্রকর্মে সজ্জিত। এ সৌধটি সামাজিক যোগাযোগ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও গোসলখানা হিসেবে ব্যবহার হত। মানুষ এ সৌধে আসত, তারপর এখানে সেমিট্রিক পুলে গোসল করত। চুনাপাথরে নির্মিত এ সৌধ দেখতে পেয়ে অনেকে বিমুগ্ধ হয়ে পড়েন। গাঞ্জি বলেন, পুলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে আমাকে রীতিমত কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়।
সিরাজের ভাকিল মসজিদ
এ মসজিদটি জাদ রাজবংশের সময়ে নির্মিত। ইরানের অন্যতম সুন্দর মসজিদ এটি। বর্ণময় সিরামিক ব্যবহার করা হয়েছে মসজিদটি নির্মাণে। গাঞ্জি বলেন, মসজিদটি আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। কারণ, এর ভেতরে অনেকগুলো স্তম্ভ ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদে যে কেউ ঢুকলেই দেখতে পাবেন এর সৌন্দর্য ও এক রাজকীয় ভাবগাম্ভীর্য রয়েছে এর চত্ত্বরে। ছবি তোলার সময় আমি চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব মসজিদের এসব বৈশিষ্ট ফুটিয়ে তুলতে।
ইসফাহানের ভ্যাঙ্ক ক্যাথিড্রাল
সপ্তদশ শতাব্দীতে আরমেনীয়রা এ ক্যাথিড্রালটি নির্মাণ করেন। এর নির্মাণকাজে দারুণ নীল ও সোনালী বর্ণের ব্যবহার ও তাতে ধর্মীয় পুস্তকের বর্ণনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অসাধারণ সব চিত্রকর্মের মধ্যে দিয়ে। এখনো আরমেনীয় খ্রিস্টানরা চার্চটি ব্যবহার করছেন এবং প্রতিদিন দর্শণার্থীরা এখানে আসেন। গাঞ্জি বলেন, চার্চের ছাদে সোনালী কারুকাজখচিত চিত্রকর্ম ক্যামেরায় ধারণ করতে আমি ওয়াইড লেন্স ব্যবহার করেছি। সূত্র : সিএনএন।