শনিবার, ১লা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

ইরানের আধুনিক কবি ওস্তাদ শাহরিয়ার

পোস্ট হয়েছে: নভেম্বর ৩, ২০২১ 

ড. মোঃ মুহসীন উদ্দীন মিয়া

ইরানের সমকালীন কাব্য জগতে যে কয়জন কবির বহুমুখী কাব্য প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিল, তাঁদের মধ্যে ওস্তাদ মুহাম্মাদ হুসাইন শাহরিয়ার ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন ইরানের রীতিসিদ্ধ ও আধুনিক ধারার যুগসন্ধিক্ষণের কবি । সনাতনী ধারায় কবিতা রচনায় যেমনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত তেমনি মুক্ত কবিতা রচনায় ছিলেন পারঙ্গম। তুর্কি ভাষায় ‘হেইদার বাবায়ে সালাম’ শিরোনামের কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে ঈর্ষণীয় খ্যাতি অর্জন করেছেন। এ ছাড়া যেনদানে ‘যেন্দেগী’ (জীবনের কারাগার), ‘দাসতাম বে দামানাত (তোমার আঁচলের উপর আমার হাত), ‘হালা চেরা?’ (এখন কেন?) ‘কারগাহে অদামসাযি’ (মানুষ তৈরির কারখানা), ‘হাতেম ভা দারভিশান’ (হাতেম ও দরবেশগণ) ইত্যাদির ন্যায় অসংখ্য ফারসি কবিতা লিখে সমভাবে সুনাম অর্জন করেছেন।
তাঁর পুরো নাম হল সাইয়্যেদ মুহম্মাদ হুসাইন বেহজাত তাবরিযী। তাঁর প্রথম দিককার কবি বা ছদ্মনাম হলো বেহজাত। পরবর্তী সময়ে তিনি মহাকবি হাফিজের দিভান (কাব্যসমগ্র) থেকে ফাল (ভাগ্য গণনা) গ্রহণ করে কাব্যনাম শাহরিয়ার ধারণ করেন। আজও তিনি এই শাহরিয়ার নামেই পরিচিত। জনশ্রুতি আছে যে, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাইয়্যেদ আবুল কাশেম তাঁকে একটি নতুন কাব্যনাম গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলে হাফিজের অনুরক্ত শাহরিয়ার হাফিজের দিভান থেকে ফাল গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ওজু করে মনোবাসনা পূরণের নিয়তে চোখ বন্ধ করে হাফিজের দিভান খুললেন। অতঃপর কবিতার ইঙ্গিতবহ দুটি চরণ তাঁর জন্য বেরিয়ে এলো। যেমন:
دوام عمر و ملک او بخواه از لطف حق ای دل
که چرخ سکه ی دولت به نام شهر باران زد
হে হৃদয়, চলমান জীবন আর রাজত্বের তরে দয়াময় প্রভুর কাছে প্রার্থনা কর,
কেননা সবসময় সৌভাগ্যের মুদ্রা বাদশাহদের নামে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
‘শাহরিয়ার’ নামটি পাবার পর তিনি এ নামটি গ্রহণ করবেন কী করবেন না এ নিয়ে দোদুল্যমান হয়ে পড়েন। আবারও চোখ বন্ধ করে হাফিজের দীভান খুললেন, এবারও তাঁর জন্য সেই ইঙ্গিতবহ নাম সম্বলিত কবিতাই বের হয়ে এল। যেমন:
غم غریبی و غربت چو بر نمی تایم
به شهر خود روم شهریار خود باشم
অচেনা ও অজানার দুশ্চিন্তা যেহেতু আমাকে উজ্জীবিত করেনি
তাই নিজ শহরে যাবো এবং নিজের বাদশাহ হবো।
উল্লিখিত পঙক্তি থেকেই তিনি শাহরিয়ার’ নামটি ভণিতা হিসেবে গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, শাহরিয়ার শব্দের অর্থ হলো বাদশা।
শাহরিয়ার ১৯০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর ও পূর্ব আজারবাইজানে প্রাদেশিক রাজধানী তাব্রিজের খোশনাব অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা পীর আগা সাইয়্যেদ ইসমাঈল মুসাভি খোশগুনাবি ছিলেন তাব্রিজের একজন আইনজ্ঞ ও উঁচুমাপের শিক্ষাবিদ। এ ছাড়া তিনি কাজার বংশীয় যুবরাজদের সহপাঠী ছিলেন।
শাহরিয়ার তাঁর শৈশব ও কৈশোর জীবনের প্রাথমিক ১৪ বছর নিজ মাতৃভূমি তাব্রিজ শহরে অতিবাহিত করেন এবং সেখানেই তিনি তাঁর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করেন।
সময় তিনি তাঁর প্রাইভেট শিক্ষকদের কাছে ও মাদ্রাসাতে তালাবিয়ায় ও ফেরদৌসিতে ফারসি, আরবি ভাষা ও সাহিত্য এবং হস্তলিপি বিদ্যা অর্জন করেন।
১৯৯১ সালে ১৬ বছর বয়সে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তেহরান গমন করেন এবং চাচার বাসায় থেকে পড়াশুনা চালিয়ে যান। তেহরানের তৎকালীন বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ দারুল ফুনুনে ভর্তি হয়ে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সম্পন্ন করেন।
১৯৯২ সালে ১৯ বছর বয়সে তিনি একই বিদ্যাপীঠের চিকিৎসা বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এখানে ৫ বৎসর অধ্যয়ন শেষে চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার জন্য ১৯২৭ সালে চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু একদিকে অর্থ কষ্ট এবং অন্যদিকে সুরাইয়া নামের এক তরুণীর প্রতি প্রেমাসক্ত হওয়ার কারণে মেডিকেলের উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি; এমনকি সুরাইয়ার সাথেও তাঁর পরিণয় ঘটেনি। প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার গ্লানি তাঁর উজ্জ্বল জীবনকে অন্ধকারে ঢেকে দেয়। তিনি বলতেন, ‘আমি যখন ডাক্তাদের সাথে অস্ত্রোপাচারে অংশ নিতাম, মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে সেলাই করে জোড়া দিতাম, তখন আমার হৃদয়-মন দুর্বল হয়ে যেত।’
দারুল ফুনুনে অধ্যয়নকালে তিনি মালেকুশ শোয়ারা বাহার, লুৎফুল্লাহ যাহেদি, আবুল হাসান সাথী, হাবিব সেফারি, ওস্তাদ ওয়ায়েযি, কারখি ইয়াজদি, আমিরি, ফিরোজ কুহি, আরেফ কাযবিনি, মিরযাদে এশকি, ইরাজ মীর্জা প্রমুখ বিখ্যাত কবির সাথে পরিচিত হন। এ সকল কবির দ্বারা পরিচালিত কবিতার আসর ও প্রতিযোগিতাসমূহে তিনি নিয়মিত অংশ নিতেন। রেজা খানের শাসন আমলে সাইয়্যেদ হাসান মুদাররেসের সাহচর্যের প্রভাবে তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। লেখাপড়া ছেড়ে দেয়ার পর তিনি ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে তেহরানের সরকারি দলিল রেজিস্ট্রি অফিসে চাকুরিতে যোগদান করেন। কিছুদিন পর নিশাপুরে বদলি হয়ে তিনি মাশহাদে চলে আসেন। ১৯৩৫ সালে পুনরায় তেহরানে প্রত্যাবর্তন করে পৌরসভার জনস্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে নিয়োজিত হন। এরপর ১৯৩৬ সালে কৃষি ব্যাংকে যোগদান করেন। ১৯৩৭ সালে তাঁর পিতা এবং পনের বছর পর ১৯৫২ সালে তাঁর মা ইন্তেকাল করেন। মাতৃবিয়োগের পর তিনি প্রচ-ভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন এবং ১৯৫৩ সালের দিকে তাব্রিজে ফিরে আসেন। অবসর গ্রহণের পর কৃষি ব্যাংক থেকে যে সামান্য পেনশন পেতেন তা দিয়ে অতি কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এই কষ্টের জীবনের কথা তিনি তার দিনের সূচনাতে ‘মুমিয়ায়ী’ (মমি) নামক কবিতায় চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।
১৯৬৭ সালে আজারবাইজান বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য হুশাঙ্গ আনছারি দেশ ও সাহিত্যে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে ওস্তাদ (শিক্ষক) উপাধি দেন। একই সাথে পূর্ব আজারবাইজানের প্রাদেশিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ঐ দিনটিকে ‘শাহরিয়ার দিবস’ ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে বার্ধক্যজনিত রোগে অসুস্থ হয়ে পড়লে শাহরিয়ারকে তেহরানে চিকিৎসার জন্য আনা হয় এবং চিকিৎসারত অবস্থায় ৮২ বৎসর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর লাশ তাব্রিজ শহরে এনে মাকবারাতুশ শোয়ারা তথা কবিদের গোরস্তানে দাফন করা হয়।
শাহরিয়ারের কাব্য প্রতিভা
শাহরিয়ার চার বছর বয়স থেকে কবিতা রচনা শুরু করেন। রুহে পিরভানে’ (প্রজাপতির আত্মা) শিরোনামে তার প্রথম দ্বিপদি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমেই কাব্যপ্রেমীদের কাছে তিনি সমাদৃত হন। তার সমসাময়িক কালের খ্যাতিমান কবি মালেকুশ শোয়ারা বাহার ও সায়ীদ নাফিসির ভুমিকা সম্বলিত এ কাব্যগ্রন্থটি ১৯৩১ সালে প্রকাশ পায়। এ প্রসংগে মালেকুশ শোহারা বাহার ‘সেদায়ে খোদা (খোদার আহ্বান) কাব্যগ্রন্থে শাহরিয়ারকে প্রাচ্যের গৌরব বলে অভিহিত করেন।
শাহরিয়ার মাতৃভাষা তুর্কি ও ফারসিতে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। ১৯৯৮ সালে কাসিদা, গজল, মাসনাভি এবং কেতয়া সম্বলিত প্রায় ত্রিশ হাজার শ্লোক সম্বলিত তাঁর কাব্যসমগ্র ‘দিভানে শাহরিয়ার’ নামে প্রকাশিত হয়। ত্রিশ হাজার শ্লোকবিশিষ্ট এ কাব্যসমগ্রটি চার খ-ে প্রকাশিত হয় এবং এর তিন হাজার শ্লোক ছিল তার মাতৃভাষা তুর্কিতে আর অবশিষ্ট সবই ছিল ফারসিতে রচিত।
তাঁর কাব্যসমগ্র পর্যালোচনা করলে এতে কবিতা রচনার বেশ কয়েকটি ধারা বা বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, তিনি ছিলেন ইরানের সাহিত্যাঙ্গনের ক্লাসিক ধারা হতে আধুনিক ধারায় প্রত্যাবর্তনের যুগ সন্ধিক্ষণের কবি। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ক্লাসিক ধারার কবিতা রচনা করতেন। বলা হয়ে থাকে, তাঁর মাধ্যমেই এ ধারার কবিতা রচনার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। সমসাময়িক কালে তাঁর সমকক্ষ কাব্য প্রতিভা খুঁজে পাওয়া নিতান্তই কঠিন ছিল। সনাতন ধারায় কাব্যচর্চার প্রতি তাঁর এ আসক্তি মূলত মহাকবি হাফিজের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ থেকেই জন্মেছে। শৈশবে দিনে হাফিজ পড়তে পড়তেই হাফিজের প্রতি তাঁর অনুরাগের সৃষ্টি হয়। এ প্রসংগে তিনি নিজেই বলেন, ‘আমি ছোট বেলায় একদিকে যেমন প্রতিদিন পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করতাম অন্যদিকে হাফিজের দিভানও পড়তাম। আমি পবিত্র কুরআনের পাশেই হাফিজের দিভান রাখতাম। হাফিজ যেমন তাঁর কবিতার প্রেরণা প্রসংগে বলেছেন,
هرجه كردم از دولت قرآن كردم
অর্থাৎ আমি যা কিছু করেছি, সবই পবিত্র কুরআন থেকেই করেছি। শাহরিয়ার তাঁরই কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলেন।
هرجه دارم از دولت حافظ دارم
অর্থাৎ আমার যা কিছু অর্জন সবই হাফিজ থেকে।’
তিনি ‘বারগাহে হাফে’ (হাফিজের দরবার), ‘হাফেযে জাভেদান’ (চিরন্তন হাফিজ), ‘ভেসালে হাফেয’ (হাফিজের মিলন) নামক কবিতা লিখে হাফিজের প্রতি তাঁর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। এ কারণেই তিনি হাফিজ শিরাযির পাচশ গজলের অনুকরণে নিজস্ব কল্পনা ও অভিব্যক্তির সম্মিলনে শত গজল রচনা করেছেন-যা পাঠ করলে মনে হবে এ যুগে বসেও হাফিজের সাথেই ভাবের আদান-প্রদান করা হচ্ছে। আরো মনে হবে হাফিজের গজলেরই প্রতিউত্তরে এ গজলগুলো রচিত হয়েছে। ‘হাতেম ভা দারভিশান’ (হাতেম ও দরবেশগণ), ‘বাদে ভাহাদাত’ (একত্ববাদের সমীরণ), ‘কারগাহে অদামসাযি (মানুষ তৈরির কারখানা) শিরোনামের কবিতাগুলোর উপজীব্য বিষয়, অভিব্যক্তি, মরমি ভাবধারা এবং । শিল্পগুণ- এ সবই হাফিজের গজলের অনুসৃত বলে প্রতীয়মান হয়। যেমন:
آسمان خود خبر از عالم درویشان است
که کمر بسته به خدمت خم درویشان است
نیست جز بی خبری در همه عالم خبری
که خبرها همه در عالم درویشان است
দরবেশ জগতের খবর হয় নিজস্ব আকাশে উদ্ভাসিত,
ন্যুব্জ দরবেশগণ সেবায় কোমর বেঁধেছে।
সারা দুনিয়ার সংবাদে খবরহীনতা ভিন্ন নেই কিছু
কেবল দরবেশগণের সংবাদেই হয় জগত পূর্ণ।
এমনকি কবিতা সম্মেলন উপলক্ষ্যে শিরায নগরীতে অবস্থানকালে শাহরিয়ারের রাতগুলো কেটেছিল হাফিজের মাজারে। সেখানে হাফিজের সামাধি থেকে তিনি আত্মিক প্রেরণা লাভ করেছেন। বিদায় বেলায় একটি আবেগময়ী গজল লিখে হাফিজের কাছ থেকে বিদায় নেন। সেই গজলের দু’টি চরণ ছিল এই রূপ:
به تودیع تو جان می خواهد از تن شد جدا حافظ
به جان کندن وداعت می کنم حافظ، خدا حافظ
তোমাকে বিদায় দিতে আমার প্রাণ ছিন্ন হতে চায় দেহ থেকে
হে হাফিজ! প্রাণটা ছিন্ন করেই তোমাকে জানাই বিদায়, খোদা হাফেজ।
শাহরিয়ার শৈশব থেকেই জীবনের পূর্ণতা ও সঠিক দিকনির্দেশনা লাভে পবিত্র কুরআনের সাথে গভীরভাবে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। নিজেকে সর্বদা পবিত্র কুরআনের কাছে ঋণী মনে করতেন। তিনি বলেন: ‘আমি যে সামান্য সাহিত্য সেবা করার সুযোগ পেয়েছি তার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমি ৬ বছর বয়স হতেই পবিত্র কুরআন পাঠের অভ্যাস গড়ে তুলি। সে বয়সেই আমি দেখে দেখে পবিত্র কুরআন পড়তে শিখি। আমার ঘরে একটি তাক ছিল যাতে সর্বদাই রাখা হত এক খ- কুরআন ও হাফিজের দিভান। বাহির থেকে ঘরে ফিরে এসে একবার পবিত্র কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করতাম আরেকবার পড়তাম দিভানে হাফেজ। ঐশী বাণীর কাব্য ঝংকারের সাথে হাফিজের কবিতার ছন্দোবদ্ধ সুর আমার চিন্তা জগতে দারুণভাবে নাড়া দিত। যেমন তিনি বলেন:
به شمع صبحدم شهریار و قرآنش
کزین ترانه به مرغان صبح خوان مانم
হে শাহরিয়ার! প্রভাতের প্রদীপ আর পবিত্র কুরআনের শপথ
এই সুর ও ছন্দের দ্যোতনায় ভোরের গায়ক পাখির সাথে তুলনীয় আমি।
পরবর্তী সময় ১৯৪১ সালে রেজাশাহ পাহলভী ও তার সন্তান মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ঘটনা শাহরিয়ারের মনে গভীর রেখাপাত করে। এ সময় থেকেই তিনি বৈষয়িক সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রদর্শিত জীবনবিধানের সাথে আত্মার বন্ধন গড়ে তোলেন। এমনকি তাঁর ধর্মানুরাগ তাঁকে সেতার বাজানো থেকেও বিরত রাখে। তিনি বলেন, ‘আসলেই মানুষের আল্লাহ হতে বিচ্ছন্ন হওয়া উচিত নয়। মানুষ যদি আল্লাহর সান্নিধ্য হতে বিচ্ছিন্ন না হয় তবে আল্লাহ নিজেই মানুষের হৃদয়ে ভাবের সঞ্চার করেন।’
তাঁর মতে কবিরা হলেন পয়গাম্বরদের চাইতে একস্তরের নিচের মর্যাদায় আসীন। নবিগণের কাছে আল্লাহর ওহী (প্রত্যাদেশ) অবতীর্ণ হয় আর কবিগণের কাছে আসে ইলহাম (ভাবসঞ্চার)। তবে শর্ত হচ্ছে কবিতার পুরোটাই হতে হবে তাওহীদভিত্তিক বা আল্লাহর একত্বের অভিব্যক্তি।
এ প্রসংগে তিনি বলেন:
غلام همت آن قهرمان کون و مکان
که بی رضای الهی نمی زند تفسی
(শাহরিয়ার) সৃষ্টি জগতের সেই অদম্য সাহসী বীরের গোলাম
যে কখনো আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া একটি নিঃশ্বাসও নেয় না।
এরপর থেকে তাঁর দিনে স্থান পেতে থাকে আধ্যাত্মিকতা সঞ্জাত ধর্মীয় কবিতাসমূহ।
যেমন: মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রশংসা, মহানবী (সা.)-এর প্রশস্তি, খোদার কাছে প্রার্থনা ও আহলে বাইতের গুণগান। মহান আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে শাহরিয়ার তাঁর মোনাজাত’ কবিতায় বলেন:
دلم جواب بلی می دهد صدای تو را
صلا بزن که به جان می خرم بلای ترا
شبانیم هوس است و طواف کعبه ی طور
مگر به گوش دلی بشنوم صدای تو را
তোমার ডাকে হৃদয় মোর ‘হ্যা’ বলে দেয় সাড়া।
ডাকো মোরে বার বার প্রাণের বিনিময়ে ক্রয় করবো যত দুর্দশা
রাখালের ন্যায় কামনা মোর কাবার তুর তাওয়াফের তরে
কিন্তু হৃদয়ে বার বার শুনি তোমার ধ্বনি।
মহানবী (সা.)-এর প্রশস্তি রচনায় ‘কেয়ামে মুহাম্মাদ’ নামক কবিতায় বলেন:
ستون عرش خدا قايم از قیام محمد (ص)
ببین که سر به کجا می کشد مقام محمد (ص)
به کارنامه ي منشور آسماني قرآن
که نقش مهر نبوت بود به نام محمد (ص)
আল্লাহর আরশের খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে মুহাম্মাদের আবিভাবে
তাকিয়ে দেখ, কোথায় পৌঁছেছে মুহাম্মাদের মর্যাদা
আসমানে প্রকাশিত কুরআন নামের আমল নামায়
মুহাম্মাদের নামই ছিল নবুয়্যতের মোহারাংকিত।
আহলে বাইত বা নবী-পরিবারকে নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি হযরত আলী (আ.)-এর সম্পর্কে অপর এক কবিতায় বলেন :
علي اي هماي رحمت تو چه آیتی خدارا
که به ماسر افکندی همه سایه ی همارا
হে আলী তুমি রহমতের পাখিতুল্য, কি অপূর্ব নিদর্শন তুমি খোদার
আল্লাহ ছাড়া সবকিছুকে ছুড়ে ফেলেছো তুমি, এমনকি সৌভাগ্যের ছায়াকেও।
তিনি অন্যত্র বলেন:
أي مظهر جمال و جلال خدا علي
یا مظهر العجايب و يا مرتضي على
از شهریار پیر زمینگیر دست گیر
اي رتگیر مردم بی دست و پا علی
হে আল্লাহর সৌন্দর্য ও মহিমার প্রকাশ আলী,
হে বিস্ময়ের প্রকাশস্থল মুরতাজা আলী।
ভূলুষ্ঠিত বৃদ্ধ শাহরিয়ারের হাত ধরে তরিয়ে নাও,
ওহে হাত-পা-শুন্য অসহায় মানুষের দরদী বন্ধু আলী।
তাঁর কবিতা দর্শন, নৈতিকতা ও মানবতার জয়গানে পরিপূর্ণ। তাই তাঁর চিরায়ত সাহিত্যকর্ম কালোত্তীর্ণ হতে পেরেছে। মহাকবি সাদি, হাফিজ ও রুমির প্রেমগীতির আধুনিক স্লোগান হিসেবে ধরা দিয়েছে শাহরিয়ারের কবিতাবলি। মানবতা ও সভ্যতার সকল সৌকর্যে পরিপূর্ণ শাহরিয়ারের কবিতা। তাঁর অসংখ্য জীবনঘনিষ্ঠ প্রেমময় গজল ভাষার দুর্বোদ্ধতা এড়িয়ে সাধারণ মানুষের কাছে অতি সহজে উপস্থাপিত হয়েছে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ, নিজস্ব চিন্তা-কল্পনা ও ভাবধারা তাঁর কবিতায় নতুনত্বের স্বাদ এনে দিয়েছে। শাহরিয়ার সংগীত খুব পছন্দ করতেন। তিনি নিজে ইরানি মিউজিক সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন এবং সেতার বাজাতে পারঙ্গম ছিলেন। এ প্রসংগে তিনি বলেন:
آنچه دیدم از نواي زندگي نامبتذل
ناله سیم سه تارم بود و دیوان غزل
জীবনের নিষ্কলুষ হৃদয় নিঃসৃত সুরে যা কিছু দেখেছি,
তা ছিল আমার সেতারের ক্রন্দন আর গজলের দিন।
আরেকটি গজলে তিনি সেতারকে ব্যথিত হৃদয়ের সাথি ও শান্তিদায়ক বলে বর্ণনা করেন:
نالد به حال زار من امشب سه تار من
این مایه تسلي شبهاي تار من
ভারাক্রান্ত হৃদয়ের কথা ব্যক্ত করতে আজ কাঁদছে আমার সিতার খানি
আমার নিকষ কালো রাতগুলোতে সান্ত¡নার মূলে ছিলো এটি।
মহাকবি হাফিজের প্রেম মদিরার ফলগুধারা শাহরিয়ারের কাব্যেও প্রবহমান ছিল। কেননা, প্রেমই বিশ্বলোকের প্রাণশক্তি। শাহরিয়ার নারীপ্রেম দিয়েই তাঁর কাব্য শুরু করে পরিশেষে সত্যিকারের প্রেমের সন্ধান লাভ করেন।
যেমন তিনি বলেন:
نقش مزار من کشید این دو سخن که شهریار
با غم عشق زاده و با غم عشق داده جان
মোর মাযারে লিখে রেখো বন্ধু এ দু’কথার স্লোগান
প্রেমের ধ্যানে জন্মেছে শাহরিয়ার, প্রেমেই দিয়েছে প্রাণ।
অন্যত্র তিনি বলেন :
عشق ای همسایه آوارگی
عشق ای سرمایه بیچارگی
راحت از بار غم دل کن مرا
یا بکش یکباره با ول کن مرا
প্রেম: হে ভবঘুরে প্রতিবেশী আমার
প্রেম হে অসহায়ত্বের পুঁজি আমার
অন্তরের চিন্তার বোঝা থেকে আমায় মুক্তি দাও
একবারে হত্যা কর অথবা ছেড়ে দাও আমায়।
তাঁর আধ্যাত্মিক প্রেমের গজলগুলো হচ্ছে ‘এন্তেজার’ (অপেক্ষা) ‘জাম ভা তাফরীক’ (সমম্বিত ও বিচ্ছিন্নতা), ‘ভাহশী শেকার’ (হিংস্র পশু শিকার), ‘ইউসুফ গোমগাশতে’ (হারানো ইউসুফ), ‘মোসাফিরে হামেদান’ (হামেদানের পথিক), ‘হারাজে এশক’ (প্রেমের নিলাম) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। শাহরিয়ার রীতিসিদ্ধ কবিতার পাশাপাশি মুক্ত কবিতা বা শেরে আযাদ রচনা করেছেন সাবলীলভাবে। তাঁর মুক্ত কবিতাগুলো অধিকাংশই ইরানের আধুনিক কাব্যের জনক নিমা ইউসিজের আফসানে’-এর (রূপকথা) আদলেই রচিত। বলা যায়, এক্ষেত্রে তিনি নিমায়ী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। নিমা আধুনিক কবিতার আঙ্গিক বিনির্মাণের লক্ষ্যে তাঁর সংক্ষিপ্ত কবি জীবনের আকাক্সক্ষা ও বেদনার দীর্ঘ কঠিন পথের চিত্র তুলে ধরেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘আফসানে’ শীর্ষক কবিতায়। এ কবিতা রচনার মধ্য দিয়েই মূলত আধুনিক একটি ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শাহরিয়ার যদিও তাঁর কবি জীবনের সূচনা করেছেন ক্লাসিক ধারার কবিতা রচনার মাধ্যমে। যদিও মাঝ পথে এসে তিনি অর্ধ রীতিসিদ্ধ। কবিতা রচনা শুরু করেন- ফারসিতে যাকে বলে ‘নিমে সুন্নাতি’। এ ধরনের কবিতার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলো ‘হাযিয়ানে দেল’ (অন্তরের অর্থহীন প্রলাপ), ‘দো মোরগে বেহেশতি’ (স্বর্গের দুই পাখি), ‘সারনেভেশতে এশক’ (প্রেমের ভাগ্যলিপি), ‘রায ভানিয়ায (রহস্য ও প্রয়োজন) ইত্যাদি। তার আধুনিক কবিতার ভাবধারা নিমায়ী ভাবধারার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হলেও রং ও ভঙ্গিমা ছিল একান্ত নিজস্ব। কেননা, এ কবিতাগুলোর বিষয় নির্বাচন ও কল্পচিত্র তৈরিতে তিনি সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। তাঁর আধুনিক ধারার উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলো হচ্ছে ‘এই ভায়াইয়ে মাদারাম’ (হায়রে আমার মা), ‘অফসানেয়ে শাব’ (রাতের রূপকথা), ‘হাযিয়ানে দেল’ (অন্তরের অর্থহীন প্রলাপ), ‘মুমিয়ায়ী’ (মমি) ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ তাঁর রচিত একটি আধুনিক কবিতার অংশ বিশেষ তুলে ধরা হলো:
در شبستان خود پای شمعی
شاعر مات و محزون نشسته
دیرگاهی است کاین کلیه را در
بر رخ یار و اغيار بسته
گرد اندوه باریده اینجا
می نماید همه چیز خسته
دفتری پیشش است و سه تاری
নিজ কক্ষে মৃদু আলোর মোমবাতির সন্নিকটে
বিষণœমনা ও চিন্তাক্লিষ্ট কোনো এক কবি একাকী বসে আছে
বহুকাল হতে ছোট সে কুটিরের দরজা
বন্ধুর মুখের উপর হয়েছে বন্ধ
দুশ্চিন্তার ধূলোরাশি প্রতিনিয়ত বর্ষিত হয় এখানে
সব কিছুই ক্লান্তিকর করে তোলে, আর
তার কাছে রয়েছে একটি খাতা ও একটি সেতার।
নিজ মাতৃভাষা তুর্কি অযারি ভাষায় তাঁর বিস্ময়কর সৃষ্টি হচ্ছে ‘হেইদার বাবায়ে সালাম’ (সালাম হায়দারবাবা)। হায়দরবাবা তাঁর গ্রামের অদূরে পাহাড়ের একটি নাম। কবি শৈশবের স্বপ্নের দিনগুলোতে তাঁর গ্রামের পাহাড়ঘেরা প্রকৃতির সাথে আত্মার যে কথোপকথন বা ভাব বিনিময় করেছেন তা-ই কবিতায় সালাম হায়দার বাবা নামে মূর্ত হয়ে উঠেছে। কবিতাটি কেবল তুর্কি ভাষাতেই নয়, বিশ্ব সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে প্রায় সত্তরের অধিক ভাষাতে অনূদিত হয়েছে। পয়ার ছন্দে লেখা এই কবিতার ভাষা অত্যন্ত সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল। তুর্কি ভাষায় তাঁর দক্ষতার জ্বলন্ত সাক্ষ বহন করে এ কবিতাটি। তুর্কি ভাষাভাষী এমন কোন শিক্ষিত লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি তুর্কি জানেন অথচ এ কবিতা পড়ে ভাষার লালিত্যে মোহিত হননি।
قارى كه ﮔتچه تاغيل دلينده
كولك قالخوب قاب يجائى توينذه
قورد ﮔچنين ستگيلين يثيتده
من قابلدوب بيرده لوشاق لولبديم
হেইদার বাবা মনে পড়ে কি আজি সেই রাতের কথা
যে রাতে বৃদ্ধ দাদীমা নানা কাহিনী বলতেন
ঝড়ো বাতাস জানালা-দরজাকে ঝাঁকুনি দিত
ক্ষুধার্ত নেকড়ে দল ছাগল দলের ওপর হানা দিত
আফসোস যদি আমি এক মুহূর্তের তরে ফিরে যেতে পারতাম সেই শৈশবে ….
শাহরিয়ারের স্বদেশপ্রেমের কবিতাগুলো পাঠক মহলে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল সীমাহীন। ‘শিভানে শাহরিভার’ (শাহরিভার মাসের শোকগাথা), ‘মেহমানে শাহরিভার’ (শাহরিভার মাসের অতিথি), ‘শাবিখুন’ (রক্তাক্ত রজনী) প্রভৃতি কবিতা তাঁর স্বদেশপ্রেমের অন্যতম নিদর্শন। তিনি ইসলামি বিপ্লবের একজন খাঁটি সমর্থক ছিলেন। শোষকের বিরুদ্ধে মজলুম ও বঞ্চিতদের প্রতিরোধ আন্দোলনই ছিল তাঁর কবিতার প্রাণশক্তি। যে কারণে কবি শাহরিয়ারের নাম ফারসি সাহিত্যাঙ্গনে চির অম্লান হয়ে থাকবে।
লেখক : অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।